ইতিহাস, দশম শ্রেণী

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য কি ছিল?

Admin

No Comments

ব্রিটিশ সরকার অরণ্য সম্পদকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন প্রবর্তন করেছিল।

ভারতীয় অরণ্য সম্পদের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার ‘অরণ্য সনদ‘ বা ‘ফরেস্ট চার্টার‘ পাশ করে। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে ‘ভারতীয় বন বিভাগ‘ বা ‘ইন্ডিয়ান ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট‘ গঠিত হয়। ভারতের রাজকীয় বন বিভাগের প্রথম ইন্সপেক্টর জেনারেল ছিলেন জার্মান বন বিশেষজ্ঞ ডিয়েট্রিস ব্রান্ডিস। তিনিই ছিলেন ভারতের ফরেস্ট সার্ভিসের প্রথম প্রধান উদ্যোক্তা।

১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রথম অরণ্য আইন পাশ হয়। ব্রিটিশ সরকার এই আইনের মাধ্যমে ভারতীয় বনাঞ্চলের ওপর তাদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতে দ্বিতীয় অরণ্য আইন পাশ হয়। এই আইনের দ্বারা অরণ্যের উপর ব্রিটিশ সরকারের অধিকার আরো সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় অরণ্য আইনে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। এই অরণ্য আইনের সংশোধনী ধারাতে ভারতীয় অরণ্যকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছ। যথা-

  1. সংরক্ষিত অরণ্য
  2. সুরক্ষিত অরণ্য বা নিরাপদ অরণ্য
  3. গ্রাম্য বনাঞ্চল

১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতে তৃতীয় অরণ্য আইন পাশ হয়। । এই আইনে অরণ্য সংক্রান্ত অপরাধ ও শাস্তিকে আরো কঠোর করা হয়। ফলস্বরূপ, আদিবাসীরা অনেক বেশি সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।

Table of Contents

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য:

ভূমিকা:

কৃষির সম্প্রসারণ, পরিবেশ সুরক্ষা ও বনভূমি সংরক্ষণ ইত্যাদির দোহাই দিয়ে ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৫ ও ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে পরপর দুটি অরণ্য আইন প্রণয়ন করেছিল। এই দুই অরণ্য আইন প্রবর্তনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ঔপনিবেশিক স্বার্থ সুরক্ষা করা এবং ভারতে বনভূমির উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।

মুনাফা অর্জন:

ব্রিটিশ সরকারের ‘অরণ্য আইন‘ প্রবর্তনের মূল উদ্দেশ্য ছিল কাঠ এবং বনজ সম্পদকে ঔপনিবেশিক স্বার্থে ব্যবহার করে মুনাফা অর্জন করা। এ ছাড়া কিছু জমির সম্প্রসারণ ঘটিয়ে মুনাফা বৃদ্ধি করা।

কাঠ সংগ্রহ ও ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি:

রেলপথের সম্প্রসারণ, রেলের কামরা, শহরের ঘরবাড়ি ও আসবাবপত্র তৈরির জন্য প্রয়োজন ছিল প্রচুর কাঠের। অন্যদিকে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর জাহাজ তৈরির জন্য প্রয়োজন ছিল উৎকৃষ্ট শাল ও সেগুন কাঠর। তাছাড়া বনজ সম্পদ হিসেবে মধু, লাক্ষা, ঔষধি গুল্ম, ভেষজ উদ্ভিদের বাণিজ্যিক চাহিদা ক্রমশ বাড়ছিল।

স্থায়ী কৃষির সম্প্রসারণ:

অরণ্য আইন প্রবর্তনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল অপরিকল্পিত ভ্রাম্যমান ঝুম চাষের পরিবর্তে বনাঞ্চল পরিষ্কার করে স্থায়ী ও সুসংঘটিত কৃষির সম্প্রসারণ করা। এছাড়া ভ্রাম্যমান সশস্ত্র বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী আদিবাসীদের শান্ত ও স্থায়ী, কৃষিজীবী ও পশুপালকে পরিণত করার জন্য ঔপনিবেশিক সরকারের অন্যতম হাতিয়ার ছিল অরণ্য আইন।

অরণ্য আইন
ডিয়েট্রিস ব্রান্ডিস

রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি:

উপনিবেশিক সরকারের আরো একটি উদ্দেশ্য ছিল নতুন কৃষি জমির উপর অত্যাধিক পরিমাণ কর আরোপ করে রাজস্ব বৃদ্ধি করা। এছাড়াও বনজ সম্পদকে বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহার করে সরকারের আই ও মুনাফা বৃদ্ধি করা।

বন সংরক্ষণ:

এটাও ঠিক যে, ব্রিটিশ সরকার ভারতের বনভূমিকে সংরক্ষিত অরণ্য, সুরক্ষিত অরণ্য এবং গ্রামীণ অরণ্য-এই তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করে বন সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে ব্রিটিশ সরকার নিজেদের স্বার্থ বজায় রাখতে গিয়ে অরণ্য আইন প্রয়োগের মাধ্যমে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবন জীবিকার মূলে আঘাত এনেছিল। যার ফলে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন আদিবাসী ও কৃষক বিদ্রোহ।

উপসংহার:

বলাবাহুল্য, এই ঔপনিবেশিক ‘অরণ্য আইন’ অরণ্যচারী আদিবাসী সম্প্রদায় কে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। অরণ্যের উপর তাদের চিরাচরিত ঐতিহ্যগত অধিকার; অর্থনৈতিক স্বাধিকার এবং নিজস্ব সংস্কৃতির বিপন্নতাকে আদিবাসী সমাজ মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। যার ফলশ্রুতি ছিল সাঁওতাল ও মুন্ডাদের মতো আদিবাসী জনক সমাজের স্বতঃস্ফূর্ত ও শঙ্ঘবদ্ধ বিদ্রোহ-যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিতকে নড়বড়ে করে দিয়েছিল।

১৯ শতকে বাংলায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজের ভূমিকা: প্রশ্নের উত্তরটি দেখতে Click করুন এখানে।

তথ্যসূত্র:

এই ব্লগের কাজ করতে Wikipedia এর সাহায্য নেয়া হয়েছে।

ঔপনিবেশিক সরকার ও অরণ্য আইন থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর:

প্রশ্ন: ‘ফরেস্ট চার্টার’ প্রণয়নের প্রধান উদ্দেশ্য কী ছিল?

উত্তর: ‘ফরেস্ট চার্টার’ প্রণয়নের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বনজ সম্পদকে ব্রিটিশ সরকারের স্বার্থে ব্যবহার করা, কাঠ ও অন্যান্য বনজ সম্পদের মুনাফা অর্জন, রেলপথের সম্প্রসারণ, কৃষি জমি থেকে রাজস্ব বৃদ্ধি এবং বনভূমি সংরক্ষণ।

প্রশ্ন: দ্বিতীয় অরণ্য আইন কবে পাস হয়?

উত্তর: ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে ঔপনিবেশিক সরকার দ্বিতীয় অরণ্য আইন পাশ করে

প্রশ্ন: ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দের দ্বিতীয় ‘ফরেস্ট চার্টার’ এ অরণ্যকে কয় ভাগে ভাগ করা হয়?

উত্তর:১৮৭৮ সালের দ্বিতীয় ‘ফরেস্ট চার্টার’ ভারতীয় বনভূমিকে তিনটি ভাগে ভাগ করেছিল: সংরক্ষিত অরণ্য, সুরক্ষিত অরণ্য, এবং গ্রাম্য বনাঞ্চল। এই আইনে বনভূমি ব্যবহারে আদিবাসীদের অধিকারের উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।

প্রশ্ন: ব্রিটিশ সরকার বনভূমি সংরক্ষণ কেন করেছিল?

উত্তর: ব্রিটিশ সরকার বনভূমি সংরক্ষণ করেছিল তাদের নৌবাহিনীর জাহাজ, রেলপথের কাঠ এবং অন্যান্য বনজ সম্পদ সুরক্ষিত রাখার জন্য। যদিও এটি আসলে ছিল তাদের ঔপনিবেশিক স্বার্থ সুরক্ষার একটি পদক্ষেপ।

প্রশ্ন: তৃতীয় ‘ফরেস্ট চার্টার’ কবে পাশ হয়?

উত্তর: তৃতীয় ‘ফরেস্ট চার্টার’ আইন ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে পাশ হয়। এতে অরণ্য সংক্রান্ত অপরাধ ও শাস্তি আরও কঠোর করা হয়েছিল।

প্রশ্ন: ‘ফরেস্ট চার্টার’ আদিবাসীদের উপর কী প্রভাব ফেলেছিল?

উত্তর: ‘ফরেস্ট চার্টার’ আদিবাসীদের জীবিকা ও ঐতিহ্যগত অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। এতে আদিবাসীরা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বিভিন্ন সময়ে বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়ে।

প্রশ্ন: ব্রিটিশ শাসনের সময় কোন কোন বিদ্রোহ ‘ফরেস্ট চার্টার’ এর ফলে সংঘটিত হয়?

উত্তর: ‘ফরেস্ট চার্টার’ এর ফলে সাঁওতাল বিদ্রোহ, মুন্ডা বিদ্রোহসহ বিভিন্ন আদিবাসী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়, যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

প্রশ্ন: প্রথম ‘ফরেস্ট চার্টার’ কখন প্রণয়ন করা হয়?

উত্তর: প্রথম ‘ফরেস্ট চার্টার’ ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের মাধ্যমে ভারতীয় বনাঞ্চলের ওপর ব্রিটিশ সরকারের একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়।

প্রশ্ন: ভারতীয় বন বিভাগের প্রথম ইন্সপেক্টর জেনারেল কে ছিলেন?

উত্তর: ভারতীয় বন বিভাগের প্রথম ইন্সপেক্টর জেনারেল ছিলেন জার্মান বন বিশেষজ্ঞ ডিয়েট্রিস ব্রান্ডিস।

প্রশ্ন: ঔপনিবেশিক ‘ফরেস্ট চার্টার’ কী ছিল?

উত্তর: ঔপনিবেশিক ‘ফরেস্ট চার্টার’ ছিল ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতে বনভূমি ও তার সম্পদের উপর সরকারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি আইন। এর মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার বনজ সম্পদ ব্যবহার করে মুনাফা অর্জন এবং রাজস্ব বৃদ্ধি করতে চেয়েছিল।

আরো পড়ুন:

Sharing Is Caring:

Leave a Comment