ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে যেসব আদিবাসী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল, সেগুলির মধ্যে সবথেকে ভয়াবহ বিদ্রোহ হলো সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দ)।
১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ শে জুন ছোটনাগপুরের ভাগনাডিহি মাঠে সিধু ও কানু নামে দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে প্রায় দশ হাজার সাঁওতাল মিলিত হয়ে স্বাধীন সাঁওতালি রাজ্য প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করেছিল। সিধু, কানু ছাড়াও এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিল চাঁদ এবং ভৈরব নামে দুই ভাই, বীর সিংহ, কালো প্রামানিক, ডোমেন মাঝি প্রমুখ। তবে প্রকৃত সাঁওতাল বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ ই জুলাই।
১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করলে সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকা রাজস্বের আওতায় আসে।কোম্পানির কর্মচারী ও জমিদারদের অত্যাচারে সাঁওতালরা তাদের আদিবাসভূমি ত্যাগ করে রাজমহলের পার্বত্য অঞ্চল ও মুর্শিদাবাদ এর একাংশের বনভূমি পরিষ্কার করে কৃষিকাজ শুরু করে। সাঁওতালরা তাদের এই নতুন অঞ্চলের নাম দেয় ‘ দামিন-ই-কোহ‘ বা ‘পাহাড়ের প্রান্তদেশ‘।
ওই অঞ্চলেও স্থানীয় জমিদার, মহাজনও ইংরেজি কর্মচারীদের অত্যাচারের শিকার হয়ে শান্তিপ্রিয় অরণ্যচারী সাঁওতালরা ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিল। সাঁওতালরা তীর ধনুক ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করলেও ইংরেজ বাহিনীর হাতে ছিল বন্দুক ও কামান। এই বিদ্রোহ ব্রিটিশ সরকারের মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এটি ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র গণসংগ্রাম। যুদ্ধে সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব পর্যায়ক্রমে নিহত হলে ১৮৫৬ সালে নভেম্বর মাসে যুদ্ধ শেষ হয় এবং বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে।
১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে সাঁওতালরা বিদ্রোহ করেছিল কেন?
ভূমিকাঃ
ব্রিটিশ শাসিত ভারতে ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করলে অন্যান্য অঞ্চলের মতো সাঁওতাল অধ্যুষিত (বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, বীরভূম ,মানভূম) অঞ্চলগুলিতে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা চালু হয়। তখন সাঁওতালরা তাদের আদি বাসভূমি ত্যাগ করে রাজমহলের পার্বত্য অঞ্চল ও মুর্শিদাবাদের একাংশে বনভূমি পরিষ্কার করে বসবাস করতে থাকে। কিন্তু সেখানে কোম্পানির কর্মচারী, জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সিধু ও কানুর নেতৃত্বে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ শুরু করে।
ভূমি রাজস্বের হারঃ
সাঁওতালরা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বনভূমি পরিষ্কার করে পাথুরে জমিকে আবাদীতে রূপান্তরিত করে নিষ্কর চাষবাস শুরু করেছিল। ব্রিটিশ সরকার ওই জমির উপর খাজনা আরোপ করে এবং খাজনার হার ১৮ বছরের মধ্যে দশগুণ বাড়ানো হয়। এছাড়া সাঁওতালদের ওপর বিভিন্ন উপসুল্ক চাপিয়ে দেয়া হলে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। যার ফলে তারা বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়।
মহাজন শোষণঃ
অভাবের তাড়নায় সাঁওতালরা ভূমি রাজস্ব ও অন্যান্য কর পরিশোধের জন্য মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিতো। এই সময় কামিয়াতি ও হারওয়াতি নামে দুই ধরনের বন্ডে সাঁওতালদের সই করতে হতো। (কামিয়াতি ব্যবস্থায় ঋণ নেওয়া সাঁওতালকে মহাজনের জমিতে বেগার খাটতে হত,হারওয়াতি ব্যবস্থায় ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ সাঁওতালদের বিনাপারিশ্রমিকে মহাজনদের জমিতে নাগুল দিয়ে চাষ করতে হতো)। ওই চুক্তি মত ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত সাঁওতালদের মহাজনের জমিতে বেগার শ্রম দিতে হতো। এছাড়া সুদের হার ছিল ৫০-৫০০ শতাংশ। সুদের অর্থ দিতে না পারলে তাদের জেলে যেতে হতো এবং অমানসিক অত্যাচার সহ্য করতে হতো।
ব্যবসায়ীদের কারচুপিঃ
দরিদ্র ও নিরক্ষর সাঁওতালদের ব্যবসায়ীরা নানা ভাবে ঠকাতো। তারা সাঁওতালদের কাছ থেকে জিনিস কেনার সময় বেশি ওজনের বাটখারা (কেনারাম) ব্যবহার করতো। এবং জিনিসপত্র বিক্রির সময় কম ওজনের বাটখারা (বেচারাম) ব্যবহার করত। একসময় সাঁওতালরা এই অসাধু ব্যবসায়ীদের কারচুপি ধরে ফেলে।
রেল কর্মচারী ও ঠিকাদারদের অত্যাচারঃ
লর্ড ডালহৌসি শাসনকালে রাজমহল, ভাগলপুর, রামপুরহাট, সাহেবগঞ্জ প্রভৃতি অঞ্চল দিয়ে রেললাইন পাতার কাজ শুরু হয়। ওই সময় ঠিকাদারা সাঁওতালদের রেলের কাজে লাগায়। কিন্তু তাদের পরিশ্রম অনুযায়ী মজুরি দিত না। আবার রেল কর্মচারীরা জোর করে তাদের হাঁস,মুরগি,পাঠা কেড়ে নিতো এবং সাঁওতাল রমণীদের উপর অকথ্য অত্যাচার করতো। এই সময় তারা আর চুপ করে না থাকতে পেরে বিদ্রোহের পথে নামে।
সাঁওতালি নিয়ম-নীতির উচ্ছেদঃ
সাঁওতাল বিদ্রোহের অন্যতম কারণ হলো, বাংলার ছোটলাট হ্যালিডে সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলে সাঁওতালি নিয়ম-নীতির উচ্ছেদ করে ইংরেজদের জটিল আইন ও বিচার ব্যবস্থা চালু করে। ফলে সাঁওতালরা বিচলিত হয়ে কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। সাঁওতাল বিদ্রোহের অন্যতম নেতা সিধু ও কানু ঘোষণা করে যে,তারা ঈশ্বরের নির্দেশ পেয়েছেন। তাই শত্রু ধ্বংসের জন্য সাঁওতালদের বিদ্রোহ করা প্রয়োজন।
ধর্মান্তরিতকরণ প্রচেষ্টাঃ
খ্রিস্টান মিশনারীরা সাঁওতালদের ধর্মকে অবজ্ঞা করতো এবং সুকৌশলে তাদের খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত করতে থাকে ফলে তারা ক্ষুব্ধ হয়।
উপসংহারঃ
আধুনিক আগ্নেয় অস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে সামান্য টাঙ্গি ও তীর ধনুক নিয়ে বিদ্রোহী সাঁওতালরা যে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল তা তুলনাহীন। প্রাথমিক পর্যায়ে এই বিদ্রোহ কৃষক বিদ্রোহ হিসেবে শুরু হলেও পরে গণ আন্দোলনের রূপ নেয়। তাই সুপ্রকাশ রায় বলেছেন,” এই বিদ্রোহ সমগ্র ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসনের ভিত্তিমূল কাপাইয়া দিয়েছিল। এবং ইহা ছিল ভারতের মহাবিদ্রোহের অগ্রদূত স্বরূপ”।
বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবা বিবাহ আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ: প্রশ্নের উত্তরটি দেখতে Click করুন এখানে ।
সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল ও গুরুত্বঃ
১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দে সংগঠিত সাঁওতাল বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হলেও এই বিদ্রোহের ফলাফল ও গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।
ব্যাপকতাঃ
আদিবাসী সাঁওতলরা এই বিদ্রোহ শুরু করলেও ক্ষোভের আগুন কামার, কুমোর, তাঁতি, ডোম, গোয়ালা, জেলে প্রভৃতি শ্রেণীর হিন্দুদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
সুদের হার হ্রাসঃ
সাঁওতালদের বিদ্রোহের ফলে সরকার তাদের ওপর মহাজনি শোষণ সম্পর্কে সচেতন হয়। সরকার সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকায় বহিরাগত মহাজনদের ঋণের সুদের হার বেঁধে দেয়।
সাঁওতাল পরগনা গঠনঃ
সরকার সাঁওতালদের পৃথক ‘উপজাতি’ হিসেবে ঘোষণা করে ছোটনাগপুর অঞ্চলে তাদের জন্য সাঁওতাল পরগনা জেলা গঠন করে দেয়।
সাঁওতালদের নিজস্ব আইনঃ
সরকার ঘোষণা করে যে, সাঁওতাল পরগণায় ব্রিটিশ আইন কার্যকর করা হবে না। সেখানে সাঁওতালদের চিরাচরিত নিজস্ব আইন ও বিচার ব্যবস্থা কার্যকরী হবে।
বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধঃ
সাঁওতালদের উপর শোষণ-অত্যাচার লাঘব করার উদ্দেশ্যে সরকার সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকায় বাঙালি মহাজনসহ বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে।
খ্রিস্টধর্মের প্রচারঃ
বহিরাগত দেশীয় মহাজনদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও সাঁওতাল অধ্যুষিত অঞ্চলে খ্রিস্টান মিশনারীদের প্রবেশ ও সাঁওতালদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচারে অবাধ সুযোগ দেয়া হয়।
মহাবিদ্রোহের অগ্রদূতঃ
ড. সুপ্রকাশ রায়ের মতে, ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল ভারতের যুগান্তকারী মহাবিদ্রোহের অগ্রদূতস্বরূপ’। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার মনে করেন যে, ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ কে স্বাধীনতা সংগ্রাম বলে অভিহিত করা হলেও ১৮৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহকেও স্বাধীনতা সংগ্রামের মর্যাদা দেওয়া উচিত।
তথ্যসূত্রঃ
এই ব্লগের কাজ করতে Wikipedia এর সাহায্য নেয়া হয়েছে।
সাঁওতাল বিদ্রোহ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তরঃ
প্রশ্ন: সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা কিভাবে হয়েছিল?
উত্তর: সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল অত্যাচারী দিঘী থানার পুলিশ মহেশ দারোগাকে হত্যার দ্বারা।
প্রশ্ন: সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রতীক কি ছিল?
উত্তর: সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রতীক ছিল শাল গাছের ডাল।
প্রশ্ন: কোন পত্রিকা সাঁওতাল বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিল?
উত্তর: ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা সাঁওতাল বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিল।
প্রশ্ন: কোন উপন্যাস থেকে সাঁওতাল বিদ্রোহের কথা জানা যায়?
উত্তর: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাস থেকে সাঁওতাল বিদ্রোহের কথা জানা যায়।
প্রশ্ন: দিকু কাদের বলা হত
উত্তর: সাঁওতাল অধ্যুষিত এলাকায় বহিরাগত মহাজনদের দিকু বলা হত।
প্রশ্ন: সাঁওতালরা তাদের অঞ্চল কে কি মনে করত?
উত্তর: সাঁওতালি অঞ্চলকে সাঁওতালরা ‘ ধরতি-আবা’ বা ‘ ভগবানের দান’ বলে মনে করত।
প্রশ্ন: সাঁওতাল বিদ্রোহ কবে সংঘটিত হয়েছিল?
উত্তর: সাঁওতাল বিদ্রোহ ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ই জুলাই শুরু হয় এবং ১৮৫৬ সালের নভেম্বর মাসে শেষ হয়।
প্রশ্ন: সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রধান নেতারা কারা ছিলেন?
উত্তর: সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রধান নেতারা ছিলেন সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব। এ ছাড়া বীর সিংহ, কালো প্রামাণিক এবং ডোমেন মাঝিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
প্রশ্ন: সাঁওতাল বিদ্রোহ কেন শুরু হয়েছিল?
উত্তর: ব্রিটিশ রাজস্ব ব্যবস্থা, মহাজনদের শোষণ, ব্যবসায়ীদের কারচুপি, রেল ঠিকাদারদের অত্যাচার এবং সাঁওতালদের ঐতিহ্যবাহী নিয়ম-নীতির উচ্ছেদ বিদ্রোহের প্রধান কারণ ছিল।
প্রশ্ন: সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলে কী কী পরিবর্তন হয়েছিল?
উত্তর: ১. মহাজনদের ঋণের সুদের হার হ্রাস করা হয়।
২. সাঁওতালদের জন্য ‘সাঁওতাল পরগনা’ জেলা গঠন করা হয়।
৩.সাঁওতাল পরগনায় তাদের নিজস্ব আইন কার্যকর হয়।
৪.বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।