ইতিহাস, দশম শ্রেণী

নীল বিদ্রোহে (1859-60খীঃ) সংবাদপত্রের ভূমিকা বিশ্লেষণ করো।

Admin

No Comments

১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দে নীল বিদ্রোহের সূচনা হয় নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরের চৌগাছা গ্রামে। এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস, দিগম্বর বিশ্বাস, রাম রতন মল্লিক, বৈদ্যনাথ ও বিশ্বনাথ সর্দার, রফিক মন্ডল প্রমুখ।

প্রাচীন কাল থেকে ভারতে নীল চাষে প্রচলন থাকলেও লুই বোনার্ড নামে এক ফরাসি বনিক এদেশে আধুনিক পদ্ধতিতে নীল চাষ শুরু করেন। তিনি ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকা থেকে নীল বীজ ও আধুনিক চাষের পদ্ধতি এদেশে নিয়ে আসেন। সম্ভবত তিনিই ছিলেন ভারতের প্রথম নীলকর। ইংরেজ বনিক কার্ল ব্লাম ভারতের সর্বপ্রথম নীল শিল্প গড়ে তোলেন।

কোম্পানির প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে ভারত বিশ্বের শ্রেষ্ঠ নীল উৎপাদন কেন্দ্রে পরিণত হয়। প্রথম দিকে নীল চাষ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া অধিকারে ছিল। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে সনদ আইনে নীল চাষের উপর কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার লোপ পায়। তখন থেকেই কৃষকদের উপর অত্যাচার শুরু হয়। তাই ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে নীল চাষিরা সংঘবদ্ধভাবে নীল চাষ করতে অসম্মত হয়। প্রথম দিকে আন্দোলন অহিংস থাকলেও চাষীদের ওপর ভয়ানক নির্যাতন, গ্রেপ্তার শুরু হলে এই আন্দোলন সশস্ত্র বিদ্রোহে পরিণত হয়।

নীল বিদ্রোহ দমন করার জন্য ইংরেজ সরকার ১৮৬০ সালে নীল কমিশন গঠন করে। এই কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে ব্রিটিশ সরকার নীল আইন পাস করেন। ফলে ১৮৬২ সালে নীল বিদ্রোহের অবসান হয়। ১৯০০ সালের মাঝে নিশ্চিন্তপুরের নীলকুঠি উঠে যাওয়ার মাধ্যমে বাংলায় সম্পূর্ণভাবে নীল চাষের অবসান ঘটে।

Table of Contents

নীল বিদ্রোহে সংবাদপত্রের ভূমিকা

ভূমিকাঃ

নীল বিদ্রোহ ছিল বাংলার কৃষকদের ওপর নীলকর সাহেবদের শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগঠিত এক বিশাল কৃষক আন্দোলন। এই বিদ্রোহে সংবাদপত্রের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা বিদ্রোহের খবর প্রচার, কৃষকদের সংগ্রামে সহানুভূতি জোগানো এবং ব্রিটিশ প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে বিদ্রোহকে সফল করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল।

সমাচার চন্দ্রিকা ও সমাচার দর্পণ পত্রিকাঃ

নীলকরদের অত্যাচার এবং কৃষকদের প্রতিবাদের ঘটনা প্রথমবার প্রকাশিত হয় ১৮২২ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ ও ‘সমাচার দর্পণ’ সংবাদপত্রে।

তত্ত্ববোধিনী ও সংবাদ প্রভাকর পত্রিকাঃ

অক্ষয় কুমার দত্ত ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় নীল চাষ ও চাষীদের দুরবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ কৃষকদের দুরবস্থা ও নীলকরদের অত্যাচারের তথ্য জনসমক্ষে তুলে ধরে।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকাঃ

নীলকরদের অত্যাচারীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সরব হয়েছিল ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা। এই পত্রিকা নীল চাষীদের নানাভাবে সাহায্য ও নীলকরদের অত্যাচারের কথা সংবাদপত্রে প্রকাশ করতো। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় নিজে এবং সাংবাদিক নিয়োগ করে নীল চাষীদের দুর্দশার খবর সংগ্রহ করে এই পত্রিকায় ‘নীল জেলা’ নামক এক পাতায় তা প্রবন্ধ আকারে প্রকাশ করতেন। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় লিখেন, বাংলার নীল চাষ একটি সংগঠিত জুয়োচুরি ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা মাত্র। বস্তুত তার উদ্যোগেই নীল বিদ্রোহের খবরা খবর বাংলার শিক্ষিত জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল।

নীল বিদ্রোহ
নীল বিদ্রোহের বিভিন্ন কেন্দ্র।

অমৃতবাজার পত্রিকাঃ

অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক শিশির কুমার ঘোষ যশোর ও নদিয়ার গ্রামে গ্রামে ঘুরে নীল চাষীদের সঙ্ঘবদ্ধ করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে চাষীদের ওপর অত্যাচারের খবর সংগ্রহ করে বাংলার প্রথম ‘ফিল্ড জার্নালিস্ট’ নামে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।

সোমপ্রকাশ পত্রিকাঃ

সোমপ্রকাশ পত্রিকা নীলকরদের প্রকৃত চরিত্র ও তাদের শোষণের ধরন সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তুলেছিল। যা কৃষক ও বিদ্রোহীদের মনে সাহস যুগিয়ে ছিল।

উপসংহারঃ

বিভিন্ন সংবাদপত্র ছাড়াও দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক ও কবি-লেখকদের রচনায় নীল চাষীদের ওপর নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী জনসম্মুক্ষে উঠে আসে। বলা যায়-পত্রপত্রিকা, বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন ও সহযোগিতা নীল বিদ্রোহকে ধর্মনিরপেক্ষ গণ বিদ্রোহে পরিণত করেছিলেন।

মাধ্যমিক ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায় 2 নম্বরের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তরগুলি দেখতে Click করুন এখানে।

তথ্যসূত্রঃ

এই ব্লগের কাজ করতে Wikipedia এর সাহায্য নেয়া হয়েছে।

নীল বিদ্রোহ ও এই বিদ্রোহে সংবাদপত্রের ভূমিকা থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তরঃ

প্রশ্ন: নীল বিদ্রোহে সমর্থনকারী কয়েকজন মধ্যবিত্তের নাম লেখ?

উত্তর: মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজের মধ্যে যারা নীল বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন-হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শিশির কুমার ঘোষ, কিশোরী চাঁদ মিত্র, মনমোহন ঘোষ, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখ।

প্রশ্ন: ‘বাংলার ওয়াট টাইলার’ নামে কে পরিচিত?

উত্তর: নীল বিদ্রোহের নেতা বিষ্ণুচরন বিশ্বাস।

প্রশ্ন: নীল বিদ্রোহের প্রথম সূচনাকারী কে ছিলেন?

উত্তর: নীল বিদ্রোহের প্রথম সূচনাকারী ছিলেন দিগম্বর বিশ্বাস।

প্রশ্ন: ‘বাংলার নানাসাহেব’ নামে কে পরিচিত?

উত্তর: নড়াইলের জমিদার রাম রতন মল্লিক ‘বাংলার নানাসাহেব’ নামে পরিচিত।

প্রশ্ন: The Blue Mutiny গ্রন্থের লেখক কে?

উত্তর: বেয়ার ক্লিং।

প্রশ্ন: নীল বিদ্রোহের প্রথম শহীদ কে ছিলেন?

উত্তর: এই বিদ্রোহের প্রথম শহীদ হলেন-মেধাই সর্দার।

প্রশ্ন: ‘নীলদর্পণ’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করেন কে?

উত্তর: মাইকেল মধুসূদন দত্ত, (The Indigo Planting Mirror)।

প্রশ্ন: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নীলদর্পণ নাটকটিকে কোন গ্রন্থের সঙ্গে তুলনা করেছেন?

উত্তর: হ্যারিয়েট বিচার স্টো রচিত-‘Uncle Tom’s Cabin (১৮৫২ খ্রিষ্টাব্দ) গ্রন্থটির সঙ্গে।

প্রশ্ন: নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ(The Indigo Planting Mirror) প্রকাশ করেন কে?

উত্তর: রেফারেন্দ জেমস লঙ।

প্রশ্ন: কোন আইন দ্বারা ব্রিটিশ সরকার ‘নীল চুক্তি আইন’ বাতিল করে?

উত্তর: ব্রিটিশ সরকার ‘অষ্টম আইন’ দ্বারা নীল চুক্তি আইন বাতিল ঘোষণা করেন।

আরো পড়ুনঃ

Sharing Is Caring:

Leave a Comment