বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা ছিল ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত প্রথম ভারতীয় জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।
পরাধীন ভারতবর্ষে উনিশ শতকে একাধিক সভা ও সমিতি গড়ে উঠেছিল। সেগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল -‘বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা‘। আধুনিক ভারতের জনক রাজা রামমোহন রায় ছিলেন ভারতের রাজনৈতিক চিন্তাধারার অগ্রদূত। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে তার মৃত্যুর পর তার অনুগামীরা যেমন-টাকির জমিদার কালীনাথ রায় চৌধুরী, দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের উদ্যোগে ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সভার প্রথম সভাপতি ছিলেন-গৌরীশংকর তর্কবাগীশ এবং প্রথম সম্পাদক ছিলেন-পন্ডিত দুর্গাপ্রসাদ তর্ক পঞ্চানন।
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভাকে প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলা হয় কেন ?
ভূমিকাঃ
উনিশ শতকের শুরুর দিকে ভারতবর্ষে, বিশেষ করে বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের প্রভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটে। ফলে সমাজে এক শ্রেণির শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠে। যারা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের কথা ভাবতে শুরু করে। এই পটভূমিতেই ১৮৩৬ সালে কলকাতায় বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা গঠিত হয়। এটি ছিল এক প্রকার সাহিত্য ও সমাজ-সচেতন সংগঠন, যা বাংলা ভাষার প্রচার ও উন্নয়ন এবং সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যে কাজ করত।
রাজনৈতিক ভাবনার সূচনাঃ
পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বোধের জাগরণ হয়। এই বোধ থেকে টাকির জমিদার কালীনাথ রায় চৌধুরী, দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা প্রতিষ্ঠা করে।
মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রয়াসঃ
১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার ইংরেজি ভাষাকে সরকারি স্তরে গুরুত্ব দেয়। এই প্রেক্ষাপটে বাংলা ভাষাশিক্ষা ও সাহিত্য চর্চা, যাতে উপেক্ষিত না হয় সে জন্য ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে ‘বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। অর্থাৎ এই কার্যকলাপ ছিল জাতীয় চেতনার বীজ রোপণের প্রক্রিয়া।
যুক্তি নির্ভর রাজনৈতিক মত প্রকাশঃ
ব্রিটিশ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে যেমন যুক্তি তর্কে বিশ্লেষণ চলত। অনুরূপভাবে ‘বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভাতে’ও রাজনৈতিক বিষয়গুলি নিয়ে যুক্তি তর্কের মাধ্যমে বিশ্লেষণ চলত।
দেশবাসীর অধিকার রক্ষাঃ
‘বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা’ ছিল এমন একটি মঞ্চ, যেখানে সমাজের নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা হতো। নারীর অধিকার, শিক্ষার প্রসার, বাল্যবিবাহ রোধ, বিধবা পুন:র্বিবাহ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সভায় মত বিনিময় হতো। এই সকল আলোচনা ছিল সমাজ সংস্কারের একধরনের সূচনা, যা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক চিন্তার দিকেও মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে।
কর আরোপের প্রতিবাদঃ
১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে রেগুলেশন অ্যাক্ট প্রয়োগ করে ব্রিটিশ সরকার নিষ্কর ভূমির ওপর কর আদায় শুরু করলে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা তার প্রতিবাদ জানায়।
উপসংহারঃ।
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা ছিল সেই সময়ের এক সাহসী ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা ভারতীয় রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। যদিও এদের কার্যকাল দীর্ঘস্থায়ী হয়নি, তবুও এ সভার প্রয়াসই ছিল রাজনৈতিক চেতনার প্রথম অঙ্কুর। যা এর পূর্বে কোন প্রতিষ্ঠানে লক্ষ্য করা যায়নি। এ কারণেই যোগেশ চন্দ্র বাগল – একে ভারতের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করেছেন।
১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ভারত সভার কার্যাবলী আলোচনা কর। সম্পূর্ণ উত্তর দেখতে Click করুন এখানে।
তথ্যসূত্র”
এই ব্লগের কাজ করতে Wikipedia এর সাহায্য নেওয়া হয়েছে।
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন-উত্তরঃ
প্রশ্ন: বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা কবে এবং কোথায় প্রতিষ্ঠিত হয় ?
উত্তর: বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রশ্ন: এই সভার প্রতিষ্ঠাতারা কারা ছিলেন?
উত্তর: সভাটির প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন টাকির জমিদার কালীনাথ রায় চৌধুরী, দ্বারকানাথ ঠাকুর ও প্রসন্ন কুমার ঠাকুর।
প্রশ্ন: এই সভার প্রথম সভাপতি ও সম্পাদক কে ছিলেন?
উত্তর: সভার প্রথম সভাপতি ছিলেন গৌরীশংকর তর্কবাগীশ এবং সম্পাদক ছিলেন পন্ডিত দুর্গাপ্রসাদ তর্ক পঞ্চানন।
প্রশ্ন: এই সভার মূল উদ্দেশ্য কী ছিল?
উত্তর: এর মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষার প্রচার, সাহিত্য চর্চা ও সমাজ সংস্কারমূলক আলোচনা।
প্রশ্ন: কেন বঙ্গ ভাষা প্রকাশিকা সভাকে ভারতের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বলা হয়?
উত্তর: কারণ এই সভা মাতৃভাষার মর্যাদা, কর আরোপের প্রতিবাদ, এবং রাজনৈতিক যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে জাতীয় চেতনার বীজ বপন করেছিল।
প্রশ্ন: এই সভা কোন ঘটনার প্রতিবাদ করেছিল ?
উত্তর: ১৮২৮ সালের রেগুলেশন অ্যাক্ট-এর মাধ্যমে নিষ্কর জমির ওপর কর আরোপের প্রতিবাদ করেছিল।
প্রশ্ন: : বঙ্গ ভাষা প্রকাশিকা সভার কার্যক্রম কীভাবে রাজনৈতিক চেতনার সূচনা করেছিল
উত্তর: সভায় জাতীয় সমস্যা, সামাজিক সংস্কার ও কর সংক্রান্ত বিষয়ে যুক্তিভিত্তিক আলোচনা হতো যা রাজনৈতিক সচেতনতার জন্ম দেয়।
প্রশ্ন: এই সভা নারী শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার নিয়ে কী করত ?
উত্তর: সভায় নারী অধিকার, বাল্যবিবাহ রোধ ও বিধবা বিবাহ নিয়ে আলোচনা হতো, যা ছিল ভবিষ্যতের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের ভিত্তি।
প্রশ্ন: বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার সাথে রাজা রামমোহন রায়ের কী সম্পর্ক ছিল ?
উত্তর: সভাটির প্রতিষ্ঠাতা ও চিন্তাধারায় রাজা রামমোহন রায়ের আদর্শ ছিল অনুপ্রেরণা স্বরূপ; সভার নেতারা ছিলেন তাঁর অনুসারী।
প্রশ্ন: বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভার ঐতিহাসিক গুরুত্ব কী?
উত্তর: এটি ছিল ব্রিটিশ শাসনে প্রথম ভারতীয় রাজনৈতিক জাগরণের প্রতীক, যা পরে জাতীয় আন্দোলনের ভিত্তি গড়ে তোলে।