ইতিহাস, দশম শ্রেণী

1831 খ্রিস্টাব্দের বারাসাত বিদ্রোহের প্রকৃতি বিশ্লেষণ কর।

Admin

No Comments

১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে সংগঠিত বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনে (বারাসাত বিদ্রোহ) নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সৈয়দ হাসান আলীর পুত্র মীর নিসার আলী। যিনি তিতুমীর নামে ইতিহাসে বিশেষ পরিচিত।

প্রথম জীবনে তিতুমীর নদীয়ার এক জমিদারের কাছে লাঠিয়ালের কাজ করতেন। ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে তিনি মক্কায় হজ করতে গিয়ে ভারতীয় ওহাবী আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আহমেদ শহীদের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে। ১৮২৭ সালে দেশে ফিরে তিতুমীর ধর্ম সংস্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ঐ যুগে বাংলার মুসলমানদের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবন নানা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। তার এই সংস্কারে মুসলমান প্রজাদের সংঘবদ্ধ হতে দেখে স্থানীয় হিন্দু জমিদারদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়।

সেই সময়ের একজন অত্যাচারী জমিদার ছিলেন পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়। তিনি ওয়াহাবি ওপর নানা রকমের কর আদায় ও তাদের প্রতি দুর্ব্যবহার করতে থাকেন। তখন তিতুমীর গ্রামের দরিদ্র নির্যাতিত কৃষকদের সাথে নিয়ে অত্যাচারী জমিদার ও নীল বিদ্রোহের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন।

তার আন্দোলন দ্রুত বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লে তিনি বারাসাত-বসিরহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইংরেজ রাজত্বের সমাপ্তি ঘোষনা করে নিজেকে ‘বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেন। মইনুদ্দিন নামক জৈনক ওহাবীকে তার প্রধানমন্ত্রী এবং নিজের ভাগ্নে গোলাম মাসুমকে তার সেনাপতি নিযুক্ত করেন।কিছুদিনের মধ্যেই তিনি উত্তর ২৪পরগনা জেলার নারকেলবেরিয়া গ্রামে একটি বাঁসের কেল্লা তৈরি করে তার দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন। এখান থেকেই তিনি বারাসাত বিদ্রোহের সূচনা করেন।

তিতুমীরের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে তার বিদ্রোহকে দমন করতে ইংরেজরা এগিয়ে আসে। ভারতের বড়লাট লর্ড বেন্টিং এর নির্দেশে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ই নভেম্বর কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে বিশাল ইংরেজ বাহিনী তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা আক্রমণ করে। অবশেষে কামানের গলার আঘাতে বাঁশের কেল্লা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ১৯শে নভেম্বর তিতুমীর যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ হারান। তার সেনাপতি গোলাম মাসুমকে কেল্লার সামনে ফাঁসি দেওয়া হয়। বাকি অনুগামীদের বন্দী করা হয়। এই ঘটনা বারাসাত বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

Table of Contents

বারাসাত বিদ্রোহের প্রকৃতি

ভূমিকাঃ

তিতুমীরের নেতৃত্বে সংগঠিত বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলন বারাসাত বিদ্রোহ(১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দ) নামে পরিচিত। ইসলাম ধর্মের পুন:রুজীবন ও সংস্কারের জন্য এই আন্দোলন শুরু হলেও ক্রমে তা ইংরেজ শাসনের অত্যাচার ও জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কৃষক আন্দোলন পরিণত হয়। তবে এই আন্দোলনের প্রকৃতি নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে।

সাম্প্রদায়িক আন্দোলনঃ

তিতুমীর ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্য দিয়ে মুসলিমদের মধ্যে সমাজ সংস্কারের চেষ্টা করেছিলেন। তাই ড.রমেশ চন্দ্র মজুমদার, বিহারীলাল সরকার, কুমুদনাথ মল্লিক প্রমুখ বারাসাত বিদ্রোহের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় চরিত্র লক্ষ্য করেছেন। ড.ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন যে, এই বিদ্রোহ ছিল হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সংগঠিত অমানবিক আক্রমণ।

মুসলিম শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠানঃ

অনেকের মতে, এই বিদ্রোহ ছিল ভারতে ব্রিটিশ শাসনের পরিবর্তে মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠার চেষ্টা মাত্র। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, এই আন্দোলন ছিল মুসলিমদের জন্য, মুসলিমদের দ্বারা এবং মুসলিম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।(It was a movement of the Muslims, by the Muslims and for the Muslims).

জাতীয় সংগ্রামঃ

কৈমুদ্দিন আহমেদ মনে করেন, বাংলার ওহাবি আন্দোলন ছিল জাতীয় সংগ্রাম। তার মতে, ইংরেজদের সঙ্গে তিতুমীরের বিরোধ দেখা দিলে তিতুমীর নিজেকে ‘বাদশাহ’ বলে ঘোষণা করেন।

বারাসাত বিদ্রোহ
বাঁশের কেল্লা

শ্রেণী সংগ্রামঃ

প্রথমদিকে তিতুমীর নীলকর বিরোধী ছিলেন না। কিন্তু নীলকররা জমিদারদের সমর্থন করলে তারা তিতুমীরের শত্রু হতে পরিণত। তাছাড়া তিতুমীর ডাকে নিম্নবর্গের সাধারণ মানুষ, হিন্দু-মুসলমান জাতি ধর্ম নির্বিশেষে শোষণের বিরুদ্ধে, নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সকলে তার লড়াইয়ে সামিল হয়েছিল। এজন্য রনজিত গুহ, নরহরি কবিরাজ তার বিদ্রোহকে ‘শ্রেণী সংগ্রাম’ বলে উল্লেখ করেছেন।

অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনঃ

ঐতিহাসিক উইলিয়াম হান্টার প্রমুখের মতে, বিদ্রোহীরা যেমন মুসলমান জমিদারদের উপর আক্রমণ করেছিল, তেমনি নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের উপর তারা কোন অত্যাচার করেনি; তাই এই আন্দোলন ছিল অসাম্প্রদায়িক।

অবহেলিত মানুষের অংশগ্রহণঃ

ডক্টর বিনয় ভূষণ চৌধুরীর মতে, বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলন বা বারাসাত বিদ্রোহ ছিল মূলত কৃষক বিদ্রোহ।ইংরেজদের ভূমিকরের বোঝা এবং জমিদারদের জুলুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীরা ইংরেজ রাজস্ব ব্যবস্থার বিরোধিতা করে এবং শোষণমুক্তির দাবি তোলে।

উপসংহারঃ

বারাসাত বিদ্রোহের প্রকৃতি কি ছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের উত্তর যাই হোক না কেন- জমিদার, নীলকর সাহেবদের শোষণ, নির্যাতন, সামাজিক অত্যাচার, অর্থনৈতিক শোষণ, ধর্মীয় অনুসাদা থেকে কৃষকদের মুক্ত করতে এই আন্দোলনের গুরুত্বকে কখনই অস্বীকার করা যায় না। নিঃসন্দেহে বলা যায়, এই আন্দোলনে ভবিষ্যৎ কৃষক আন্দোলন গুলির পথ তৈরি করেছিল।

স্বামী বিবেকানন্দের ধর্ম সংস্কারের আদর্শ ব্যাখ্যা কর: উত্তরটি দেখতে Click করুন এখানে।

তথ্যসূত্রঃ

এই ব্লগের কাজ করতে Wikipedia এর সাহায্য নেয়া হয়েছে।

ওয়াহাবি আন্দোলন ও তিতুমীর সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তরঃ

প্রশ্ন: ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা কে করেন?

উত্তর: আব্দুল ওয়াহাব আরব দেশে ওহাবী আন্দোলনের সূচনা করেন।

প্রশ্ন: ‘ওয়াহাবি’ শব্দের অর্থ কি?

উত্তর: ওয়াহাবি শব্দের অর্থ-নবজাগরণ বা পুনর্জাগরণ।

প্রশ্ন: ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের সূচনা কে করেছিলেন?

উত্তর: শাহ ওয়ালিউল্লাহ ভারতে ওয়াহাবিআন্দোলনের সূচনা করেছিলেন।

প্রশ্ন: ভারতে ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা কে?

উত্তর: ভারতে ওহাবী আন্দোলনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হলেন উত্তরপ্রদেশের রায়বেরিলির বাসিন্দা সৈয়দ আহমদ।

প্রশ্ন: বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনে নেতৃত্ব কে দিয়েছিলেন?

উত্তর: বাংলায় ওয়াহাবি আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিতুমীর ওরফে মীর নিসার আলী।

প্রশ্ন: তিতুমীরের প্রকৃত নাম কি ছিল?

উত্তর: তিতুমীরের প্রকৃত নাম ছিল মীর নিসার আলী।

প্রশ্ন: ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত নাম কি ছিল?

উত্তর: ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রকৃত নাম ছিল ‘তারিখ-ই-মোহাম্মদিয়া’ অর্থাৎ ‘মুহম্মদ নির্দেশিত পথ’।

প্রশ্ন: কার নেতৃত্বে ইংরেজ বাহিনী তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা আক্রমণ করে?

উত্তর: লর্ড বেন্টিং এর নির্দেশে ১৮৩১ সালের ১৪ই নভেম্বর কর্নেল স্টুয়ার্ট নেতৃত্বে বিশাল ইংরেজ বাহিনী তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা আক্রমণ করে।

প্রশ্ন: কৃষ্ণদেব রায় কে ছিলেন?

উত্তর: কৃষ্ণদেব রায় ছিলেন পুঁড়ার জমিদার। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, কেউ তিতুমীরের শিষ্যত গ্রহণ করলে এবং দাড়ি রাখলে তাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হবে এবং যারা তিতুমীরকে বাড়িতে আশ্রয় দেবে তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হবে।

প্রশ্ন: ওয়াহাবি আন্দোলনের মূল লক্ষ্য কি ছিল?

উত্তর: ওয়াহাবি আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল ইসলাম ধর্মের কুসংস্কার গুলো দূর করা এবং পবিত্র কোরআনের আদর্শে ইসলামের শুদ্ধিকরণ ঘটানো।

প্রশ্ন: তিতুমীর বাঁশের কেল্লা কোথায় নির্মাণ করেছিলেন?

উত্তর: উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার নারকেলবেড়িয়া গ্রামে তিতুমীর বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেছিলেন।

আরো পড়ুনঃ

Sharing Is Caring:

Leave a Comment