বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স দল বরিশালের তরুণ হেমচন্দ্র ঘোষের উদ্যোগে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে গঠিত হয়।এই দলের অন্যতম সদস্য ও সংগঠক ছিলেন সত্য গুপ্ত।
১৯০২ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় পুলিনবিহারী দাশের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মুক্তিসংঘ’ নামে একটি বিপ্লবী প্রতিষ্ঠান। এর অন্যতম সদস্য ছিল উল্লাসকর দত্ত, হেমচন্দ্র ঘোষ, বারিন ঘোষ প্রমুখ বিপ্লবী। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের বাৎসরিক অনুষ্ঠান চলাকালে সুভাষচন্দ্র বসু একটি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গঠন করেন। এই বাহিনীতে বাংলার ছাত্র যুবক ও মহিলারা যোগদান করেন। এই বাহিনীর সঙ্গে ‘মুক্তিসংঘ” একত্রিত হয়ে গঠিত হয় বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স দল। এর সদর দপ্তর ছিল ঢাকা। গান্ধীজী এই বিপ্লবী দলের কার্যকলাপকে ‘পার্ক সার্কাসের সার্কাস’ বলে ব্যঙ্গ করলেও ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে এদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স দলের ভূমিকা বিশ্লেষণ কর।
ভূমিকাঃ
উনিশ শতকের শেষভাগে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই ধারার এক অন্যতম সংগঠন ছিল “বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স”(বাংলার স্বেচ্ছাসেবক) দল। ১৯২৮ সালে কলকাতার কংগ্রেসের অধিবেশনে পন্ডিত মোতিলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্র বসুর উদ্যোগে এই সংগঠনের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ ঘটে।
লোম্যান হত্যাঃ
বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স দলের অন্যতম সদস্য বিনয় কৃষ্ণ বসু বাংলা পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল লোম্যানকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৩০ সালের ২৯ আগস্ট বিনয় সাধারন বেশভূষায় নিরাপত্তা গণ্ডিকে ফাঁকি দিয়ে লোম্যানর খুব কাছে চলে এসে গুলি করেন। দুইদিন পর তার মৃত্যু হয়। এরপর বিনয় বসু পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স দলের অ্যাকশন কোয়াডের প্রধান সুপ্রতি রায়ের সাহায্যে কলকাতায় পালিয়ে যান।
রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমনঃ
১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে ৮ই ডিসেম্বর বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার দলের তিন তরুণ বিপ্লবী সদস্য বিনয় কৃষ্ণ বসু, বাদল গুপ্ত এবং দীনেশ গুপ্ত বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের মূল কেন্দ্র রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান করেন। তারা কারা বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল সিম্পসনকে হত্যা করেন। তাদের সঙ্গে রাইটার্স বিল্ডিং এর বারান্দায় ব্রিটিশ পুলিশের যে খন্ড যুদ্ধ হয় তা ‘অলিন্দ যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। তারপর বিনয় ও বাদল আত্মহত্যা করেন এবং দীনেশ গুপ্তের ফাঁসি হয়। এই ঘটনা পুরো দেশে আলোড়ন তোলে।
গার্লিক হত্যাঃ
দীনেশ গুপ্তকে যে জর্জ ফাঁসি দেয় তার নাম গার্লিক। তার ফাঁসির ঠিক এক বছর কুড়ি দিন পর আলিপুর জর্জ কোর্টের অভ্যন্তরে তরুণ বিপ্লবী কানাইলাল ভট্টাচার্যের গুলিতে নিহত হন। এই ঘটনা ব্রিটি সাম্রাজ্যবাদীদের স্বচকিত করে তোলে।
মেদিনীপুরে হত্যাঃ
মেদিনীপুরে কর্মরত বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স দলের সদস্যদের কর্মধারা ছিল ব্রিটিশ শাসনকুলকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তোলা। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবী বিমল দাশগুপ্ত ও জ্যোতিজীবন ঘোষের হাতে মেদিনীপুরের জেলাশাসক পেডি, ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে প্রদ্যত ভট্টাচার্যের হাতে জেলাশাসক ডগলাস এবং ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে অনাথ পাঁজা ও মৃগেন দত্তের হাতে জেলা শাসক বার্জ নিহত হন।
উপসংহারঃ
বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স দল ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে এক সাহসী ও গৌরবময় অধ্যায়। তারা জীবন উৎসর্গ করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে তীব্রতর করে তোলে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে যুবসমাজকে উজ্জীবিত করে। এদের আত্মত্যাগ জাতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা বিশ্লেষণ কর। সম্পূর্ণ উত্তর দেখতে Click করুন এখানে।
তথ্যসূত্রঃ
এই ব্লগের কাজ করতে Wikipedia এর সাহায্য নেয়া হয়েছে।
FAQ
প্রশ্ন: বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স দল কবে ও কার উদ্যোগে গঠিত হয় ?
উত্তর: ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে বরিশালের তরুণ বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের উদ্যোগে দলটি গঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৯২৮ সালে কলকাতার কংগ্রেস অধিবেশনে দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে, পন্ডিত মোতিলাল নেহরু ও সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে।
প্রশ্ন: ‘মুক্তিসংঘ’ কী এবং এর সঙ্গে বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স দলের সম্পর্ক কী ?
উত্তর: ‘মুক্তিসংঘ’ ছিল ১৯০২ সালে পুলিনবিহারী দাশের নেতৃত্বে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত একটি বিপ্লবী সংগঠন। পরবর্তীতে এই সংগঠনটি বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স দলের সঙ্গে একত্রিত হয়।
প্রশ্ন: লোম্যান হত্যাকাণ্ডে কে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং এটি কবে সংঘটিত হয় ?
উত্তর: বিনয় কৃষ্ণ বসু এই হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দেন। ১৯৩০ সালের ২৯ আগস্ট তিনি ইন্সপেক্টর জেনারেল লোম্যান-কে গুলি করেন, যার ফলে দুই দিন পর তার মৃত্যু হয়।
প্রশ্ন: রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান কী এবং এতে কারা অংশ নেন ?
উত্তর: রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান ছিল ১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর সংঘটিত এক বিপ্লবী হামলা, যেখানে বিনয়, বাদল ও দীনেশ কর্নেল সিম্পসন-কে হত্যা করেন। এটি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অন্যতম সাহসী অভিযান হিসেবে বিবেচিত।
প্রশ্ন: ‘অলিন্দ যুদ্ধ’ বলতে কী বোঝায় ?
উত্তর: অলিন্দ যুদ্ধ বলতে বোঝানো হয় রাইটার্স বিল্ডিং অভিযানের সময় ব্রিটিশ পুলিশ ও বিপ্লবীদের মধ্যে রাইটার্স বিল্ডিং-এর বারান্দায় সংঘটিত খণ্ডযুদ্ধকে।
প্রশ্ন: গার্লিক হত্যাকাণ্ড কে ঘটান এবং কেন ?
উত্তর: বিপ্লবী কানাইলাল ভট্টাচার্য ১৯৩১ সালে বিচারক গার্লিক-কে হত্যা করেন, যিনি বিপ্লবী দীনেশ গুপ্তকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন। এই হত্যাকাণ্ড আলিপুর জজ কোর্টে সংঘটিত হয়।
প্রশ্ন: মেদিনীপুরে বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স দলের প্রধান কার্যকলাপ কী ছিল ?
উত্তর: মেদিনীপুরে তারা ধারাবাহিকভাবে ব্রিটিশ জেলা শাসকদের হত্যা করেন।
উল্লেখযোগ্য হত্যাকাণ্ডগুলো:
১৯৩১: পেডি
১৯৩২: ডগলাস
১৯৩৩: বার্জ
প্রশ্ন: বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স দলের সদর দপ্তর কোথায় ছিল ?
উত্তর: ভবেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স দলের মূল সদর দপ্তর ছিল ঢাকায়।
প্রশ্ন: গান্ধীজী এই দলের কার্যকলাপ সম্পর্কে কী মন্তব্য করেছিলেন ?
উত্তর: গান্ধীজী বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স দলের সশস্ত্র কার্যকলাপকে ব্যঙ্গ করে একে “পার্ক সার্কাসের সার্কাস” বলে উল্লেখ করেছিলেন।
প্রশ্ন: স্বাধীনতা সংগ্রামে বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স দলের গুরুত্ব কী ?
উত্তর: এই দল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তাদের আত্মত্যাগ ও সাহসিকতা ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।