ইতিহাস, দশম শ্রেণী

বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ

Admin

No Comments

বাংলার নমঃশূদ্র আন্দোলন ছিল একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন, যা মূলত তৎকালীন পূর্ববঙ্গে নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের অধিকার আদায়ের জন্য পরিচালিত হয়েছিল।

নমশূদ্র সম্প্রদায় পূর্বে চন্ডাল নামে পরিচিত ছিল । তারা চার-স্তরের বর্ণ ব্যবস্থার বাইরে বসবাস করত কারণ তারা এই বর্ণ ব্যাবস্থার বিরোধী ছিলেন। তাই তথাকথিত বা স্বঘোষিত হিন্দু ‘উচ্চ বর্ণ’ সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে তারা ছিল বহিষ্কৃত। তার মূল সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী ছিল।

নমঃশূদ্ররা বাংলার অন্যতম প্রধান নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়, যাঁদের ঐতিহাসিকভাবে ‘অস্পৃশ্য’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এ কারণে সমাজে তারা দীর্ঘদিন বৈষম্যের শিকার হন এবং শিক্ষা, চাকরি ও অন্যান্য সামাজিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকেন।

Table of Contents

বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

ভূমিকাঃ

নমঃশূদ্র আন্দোলন ছিল বাংলার নিম্নবর্ণের নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগঠিত একটি আন্দোলন। এটি মূলত ১৯ শতকের শেষ ভাগ থেকে ২০ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সংগঠিত হয় এবং এর মূল লক্ষ্য ছিল জাতিভেদ প্রথার অবসান, সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা।

আন্দোলনের কারণঃ

সামাজিক বৈষম্য:

নমঃশূদ্ররা হিন্দু সমাজের নিম্নবর্ণের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারা অস্পৃশ্যতার শিকার হত এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে তাদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল।

অর্থনৈতিক শোষণ:

নমঃশূদ্ররা প্রধানত কৃষক ও শ্রমিক ছিল। জমিদার ও মহাজনদের দ্বারা তারা শোষিত হত। তাদের জমিজমা কেড়ে নেওয়া হত, এবং অল্প মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য করা হত।

রাজনৈতিক অধিকারের অভাব:

নমঃশূদ্রদের রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। আইনসভা ও স্থানীয় প্রশাসনে তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না।

শিক্ষা ও সচেতনতার অভাব:

নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার হার ছিল খুবই কম। এর ফলে তারা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন ছিল না।

আন্দোলনের সূচনাঃ

১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে বাখরগঞ্জের আমগ্রামের এক নমঃশূদ্রের বাপের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে স্থানীয় কায়স্থ ও উচ্চ বর্ণের লোকেরা নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তার প্রতিবাদে নমঃশূদ্ররা আন্দোলন শুরু করেছিলেন। উচ্চবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের এই ঘৃণা, শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলন (১৮৭২-১৯৪৭) খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শক্তিশালী হয়ে ওঠেছিল।

নমঃশূদ্র আন্দোলন
গুরুচাঁদ ঠাকুর

আন্দোলনের মূল নেতা ও কার্যক্রমঃ

হরিচাঁদ ঠাকুর (১৮১২-১৮৭৮):

হরিচাঁদ ঠাকুর অসহায়, দলিত, নিপীড়িত নমঃশূদ্র সম্প্রদায় কে সঙ্গবদ্ধ করার জন্য ‘মতুয়া’ নামে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি তার অনুগামীদের সবার ঊর্ধ্বে মানুষকে ঠাঁই দেওয়ার কথা বলেন এবং দ্বাদশ আজ্ঞা পালনের নির্দেশ দিয়ে দেন। মতুয়া ধর্মকে কেন্দ্র করে নমঃশূদ্ররা ঐক্যবদ্ধ হন এবং আন্দোলনের সক্রিয় হয়ে ওঠে।

গুরুচাঁদ ঠাকুর (১৮৪৬-১৯৩৭):

হরিচাঁদ ঠাকুরের যোগ্য উত্তরসূরী গুরুচাঁদ ঠাকুর নমঃশূদ্রদের সামাজিক ও ধর্মীয় উন্নতির জন্য ‘মতুয়া’ ধর্ম প্রচার করেন এবং শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ৩৯৫২ টি বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন-‘খাও বা না খাও তাতে কোন দুঃখ নাই। ছেলে মেয়ে শিক্ষা দাও এই আমি চাই।।’

অন্যান্য নেতৃত্ব:

এছাড়া মুকুন্দবিহারী মল্লিক, রাজেন্দ্রনাথ মন্ডল, বিরাটচন্দ্র মন্ডল, যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, প্রমথরঞ্জন ঠাকুর প্রমুখ নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষদের আর্থসামাজিক সমস্যা দূর করার উদ্দেশ্যে আন্দোলন করেছিলেন।

আন্দোলনের ফলাফলঃ

সামাজিক উন্নতি:

নমঃশূদ্ররা তাদের সামাজিক অবস্থান উন্নীত করার জন্য বিভিন্ন সংস্কারমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে। এর মধ্যে ছিল শিক্ষা বিস্তার, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ এবং সামাজিক কুপ্রথাগুলির বিরোধিতা।

রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন:

নমঃশূদ্ররা তাদের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য সক্রিয় ছিল। তারা আইনসভা ও স্থানীয় প্রশাসনে প্রতিনিধিত্বের দাবি জানায়।

উপসংহারঃ

নমঃশূদ্র আন্দোলন বাংলার নিম্নবর্ণের মানুষদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ সমাজসংস্কার আন্দোলন ছিল। এটি কেবল জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করেনি, বরং সমাজে তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পথও সুগম করেছিল। এই আন্দোলনের ফলে বাংলার নমঃশূদ্র সম্প্রদায় শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয় এবং রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করে।

মানুষ প্রকৃতি ও শিক্ষার সমন্বয় বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা: প্রশ্নের উত্তরটি সম্পূর্ণ দেখতে Click করুন এখানে।

তথ্যসূত্রঃ

এই ব্লগের কাজ করতে Wikipedia এর সাহায্য নেয়া হয়েছে।

বাংলায় নমঃশূদ্র আন্দোলন থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তরঃ

প্রশ্ন: নমঃশূদ্র আন্দোলন কী?

উত্তর: নমঃশূদ্র আন্দোলন ছিল বাংলার নিম্নবর্ণের নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগঠিত একটি আন্দোলন। এটি ১৯ শতকের শেষ ভাগ থেকে ২০ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সংগঠিত হয়।

প্রশ্ন: নমঃশূদ্র আন্দোলনের প্রধান কারণ কী ছিল?

উত্তর: এই আন্দোলনের প্রধান কারণ ছিল সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক অধিকারহীনতা এবং শিক্ষার অভাব। নমঃশূদ্র সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের দ্বারা অবহেলিত ও নিপীড়িত ছিল।

প্রশ্ন: হরিচাঁদ ঠাকুরের ভূমিকা কী ছিল?

উত্তর: হরিচাঁদ ঠাকুর মতুয়া ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষের সামাজিক উন্নয়ন, শিক্ষা বিস্তার এবং জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন।

প্রশ্ন: গুরুচাঁদ ঠাকুর কীভাবে নমঃশূদ্র আন্দোলনকে এগিয়ে নেন?

উত্তর: গুরুচাঁদ ঠাকুর তার পিতার আদর্শ অনুসরণ করে নমঃশূদ্রদের শিক্ষিত করার জন্য প্রচারণা চালান। তিনি ৩৯৫২টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং নমঃশূদ্রদের আত্মনির্ভরশীল হতে উৎসাহিত করেন।

প্রশ্ন: নমঃশূদ্র আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা কারা ছিলেন?

উত্তর: হরিচাঁদ ঠাকুর, গুরুচাঁদ ঠাকুর, মুকুন্দবিহারী মল্লিক, রাজেন্দ্রনাথ মন্ডল, যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল এবং প্রমথরঞ্জন ঠাকুর এই আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন।

প্রশ্ন: নমঃশূদ্র আন্দোলনের ফলে কী ধরনের সামাজিক পরিবর্তন আসে?

উত্তর: এই আন্দোলনের ফলে নমঃশূদ্রদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটে, অস্পৃশ্যতা কমে আসে, রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায় এবং তারা সমাজে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।

প্রশ্ন: মতুয়া সম্প্রদায় কী?

উত্তর: মতুয়া একটি ধর্মীয় ও সামাজিক সম্প্রদায় যা হরিচাঁদ ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেন। এটি নমঃশূদ্রদের ঐক্যবদ্ধ করে তাদের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার শিক্ষা দেয় এবং জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করে।

প্রশ্ন: নমঃশূদ্র আন্দোলনের রাজনৈতিক গুরুত্ব কী ছিল?

উত্তর: নমঃশূদ্ররা রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের জন্য লড়াই করে এবং ধীরে ধীরে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব লাভ করে, যা ভারতীয় রাজনীতিতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সহায়তা করে।

প্রশ্ন: নমঃশূদ্রদের প্রতি উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মনোভাব কেমন ছিল?

উত্তর: উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নমঃশূদ্রদের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন মেনে নিতে চায়নি। তারা নমঃশূদ্রদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ করত এবং আন্দোলন দমিয়ে রাখার চেষ্টা করত।

প্রশ্ন: নমঃশূদ্র আন্দোলনের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব কী?

উত্তর: এই আন্দোলনের ফলে নমঃশূদ্ররা নিজেদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়। এটি শিক্ষার প্রসার ঘটায়, জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা দেয় এবং ভারতীয় রাজনীতিতে নিম্নবর্ণের মানুষের অংশগ্রহণ বাড়াতে সাহায্য করে।

আরো পড়ুনঃ

Sharing Is Caring:

Leave a Comment