মুন্ডা বিদ্রোহ(১৮৯৯-১৯০০)যা ‘উলগুলান‘ বা ‘মহান বিদ্রোহ‘ নামেও পরিচিত একটি আদিবাসী বিদ্রোহ। যেটি বর্তমান ঝাড়খণ্ড অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছিল।
মুন্ডা বিদ্রোহের কারণঃ
ভূমিকাঃ
উনিশ শতকের শেষভাগে ব্রিটিশ শাসনের অবিচার, জমিদারি ও মহাজনী শোষণের বিরুদ্ধে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে একের পর এক গণবিদ্রোহ সংঘটিত হতে থাকে। তার মধ্যেই অন্যতম মুন্ডা বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে সংগঠিত (১৮৯৯-১৯০০) একটি আদিবাসী কৃষক বিদ্রোহ। বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে রাঁচি ও সিংভূম অঞ্চলে এই বিদ্রোহের সূচনা হয়।
ভূমি ব্যবস্থার পরিবর্তনঃ
গভীর জঙ্গল পরিষ্কার করে মুন্ডারা তাদের ঐতিহ্যগত ‘খুৎকাঠি’ প্রথা অনুসরণ করে, যৌথ মালিকানার ভিত্তিতে জমি চাষ করত ও জমির সত্ব ভোগ করতো। ব্রিটিশ সরকার এই প্রথা বিলোপ করে জমিদারি ব্যবস্থা চালু করে। যার ফলে জমিদার ও মহাজনদের হাতে তাদের জমি চলে যায়। এবং তারা হয়ে ওঠে নিজেদের জমিতেই ক্ষেতমজুর। ফলে মুন্ডারা ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়।
মহাজনী শোষণ ও ঋণের ফাঁদঃ
ব্রিটিশ সরকার ও জমিদাররা মুন্ডাদের জমি দখল করে তাদের উপর নানা ধরনের করের বোঝা চাপিয়ে দেয় এবং তা আদায়ে অত্যাচার চালায়। এই অত্যাচার থেকে রক্ষা পেতে তারা মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিত। কিন্তু উচ্চ সুদে সেই ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে তারা দাসত্বে বাধ্য হতো। এই অর্থনৈতিক শোষণ বিদ্রোহের একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
ধর্মীয় হস্তক্ষেপ ও সংস্কৃতির হুমকিঃ
খ্রিস্টান মিশনারিরা মুন্ডা সমাজে খ্রিস্টধর্ম প্রচার ও নানা কৌশলে তাদের ধর্মান্তরিত করতে শুরু করে। এছাড়া তারা মুন্ডাদের নিজস্ব ধর্ম ও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে নানা প্রকার অপপ্রচার প্রচার করত। এতে মুন্ডাদের নিজস্ব ধর্ম, বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান বিপন্ন হয়ে পড়ে। তারা মনে করতে থাকে, তাদের প্রাচীন সংস্কৃতি ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে মুন্ডা সমাজে বিরাট প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বীরসা মুন্ডা নিজেই এই সময় ধর্মীয় নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং মুন্ডা ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করতে “বিরসাইট ধর্ম” চালু করেন।
নেতৃত্বঃ
বিরসা মুন্ডা মুন্ডাদের ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীন মুন্ডা রাজ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। তিনি নিজেকে ঈশ্বরের দূত হিসেবে পরিচয় দেন এবং ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত করেন। তিনি ‘উলগুলান’ অর্থাৎ বিপ্লবের ডাক দেন। তাঁর নেতৃত্বে মুন্ডারা জমি, অধিকার ও সংস্কৃতি রক্ষায় সশস্ত্র প্রতিরোধে নামেন। তাঁর প্রভাবেই বিদ্রোহ সংগঠিত হয়।

উপসংহারঃ
মুন্ডা বিদ্রোহ ছিল কেবল একটি জমি বা ধর্মের লড়াই নয়। এটি ছিল একটি জাতির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। ভূমি হারানো, শোষণের শিকার হওয়া, ধর্ম ও সংস্কৃতির ওপর আক্রমণ – এই সবকিছুর বিরুদ্ধে বীরসা মুন্ডার নেতৃত্বে মুন্ডা সম্প্রদায় এক ঐতিহাসিক প্রতিবাদ গড়ে তোলে। এই বিদ্রোহ ভারতের উপজাতীয় ইতিহাসে একটি গর্বের অধ্যায় হয়ে রয়েছে।
মুন্ডা বিদ্রোহের (1899-1900) গুরুত্ব বিশ্লেষণ করঃ
ভূমিকাঃ
ব্রিটিশ সরকারের কঠোর দমননীতির ফলে ১৮৯৯-১৯০০খ্রিস্টাব্দে সংগঠিত মুন্ডা বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। বিদ্রোহের নেতা বিরসা মুন্ডা কে জেলে পাঠানো হয়। সেখানেই তিনি ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। অনেক বিদ্রোহীকে ফাঁসি দেওয়া হয় আবার অনেকের কারাবাস হয়। এত্বদ সত্ত্বেও মুন্ডা বিদ্রোহের গুরুত্ব ছিল সুদূরপ্রসারী।
ছোটনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইনঃ
মুন্ডা বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার মুন্ডাদের অভাব-অভিযোগ দূর করতে সচেষ্ট হয়। এই জন্য সরকার ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ছোটনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন পাস করে আদিবাসীদের জমি অধিকারে সুরক্ষা দেয়। এই আইনের মাধ্যমে সরকার মুন্ডাদের চিরাচরিত খুৎকাঠি বা জমির যৌথ মালিকানা প্রথাকে স্বীকার করে নেয়।
বেটবেগারির অবসানঃ
জমিদার, মহাজন ও ঠিকাদারদের কাছে মুন্ডাদের বাধ্য হয়ে বেগার শ্রম দিতে হতো। যা ছিল এই বিদ্রোহের অন্যতম কারণ। তাই বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার মুন্ডাদের বেগার শ্রম দেওয়ার প্রথাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
বীরসা সম্প্রদায়ের উদ্ভবঃ
মুন্ডা বিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে মুন্ডা সমাজে ‘বীরসা সম্প্রদায়’ নামে একটি নতুন সাম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। তারা বীরশাকে ভগবান রূপে পূজা করতে শুরু করে। এই মুন্ডা সম্প্রদায় সমাজে সংস্কার আন্দোলন চালানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিয়েছিল।
তানাভগৎ আন্দোলনঃ
এই বিদ্রোহের সূত্র ধরে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ছোটনাগপুর অঞ্চলে ওরাও আদিবাসী সম্প্রদায় টানা ভগত আন্দোলন সূচনা করে তারা ঘোষণা করে জমির জন্য তারা সরকারকে কোন পর দেবে না
উপসংহারঃ
মুন্ডা বিদ্রোহ ভারতের উপজাতীয় সমাজের এক জাগরণ মুহূর্ত। এটি ছিল কেবল একটি শোষণবিরোধী আন্দোলন নয়, বরং আত্মপরিচয়, ধর্মীয় সংস্কার এবং সামাজিক সম্মান রক্ষার সংগ্রাম। বিরসা মুন্ডা ও তাঁর ‘উলগুলান’ আজও ভারতীয় ইতিহাসে গৌরবের সঙ্গে স্মরণীয়।
সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ ও গুরুত্ব বিশ্লেষণ কর। সম্পূর্ণ উত্তরটি দেখতে Click করুন এখানে।
তথ্যসূত্রঃ
এই ব্লগের কাজ করতে Wikipedia এর সাহায্য নেওয়া হয়েছে।
মুন্ডা বিদ্রোহ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন-উত্তরঃ
প্রশ্ন: মুন্ডা বিদ্রোহ কবে সংঘটিত হয়েছিল ?
উত্তর: মুন্ডা বিদ্রোহ ১৮৯৯ থেকে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত হয়।
প্রশ্ন: মুন্ডা বিদ্রোহ কোথায় সংঘটিত হয়েছিল ?
উত্তর: এটি বর্তমান ঝাড়খণ্ডের রাঁচি ও সিংভূম অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছিল।
প্রশ্ন: মুন্ডা বিদ্রোহের প্রধান নেতা কে ছিলেন ?
উত্তর: এই বিদ্রোহের প্রধান নেতা ছিলেন বিরসা মুন্ডা।
প্রশ্ন: মুন্ডা বিদ্রোহকে আর কী নামে ডাকা হয় ?
উত্তর: এই বিদ্রোহকে ‘উলগুলান’ বা ‘মহান বিদ্রোহ’ নামেও ডাকা হয়।
প্রশ্ন: : মুন্ডা বিদ্রোহ কেন শুরু হয়েছিল ?
উত্তর: জমিদারি প্রথা, মহাজনী শোষণ, ধর্মীয় হস্তক্ষেপ এবং সংস্কৃতি ধ্বংসের ভয় থেকে এই বিদ্রোহ শুরু হয়
প্রশ্ন: ব্রিটিশ সরকার মুন্ডা বিদ্রোহের পর কী পদক্ষেপ নিয়েছিল ?
উত্তর: বিদ্রোহ দমন করার পর ১৯০৮ সালে ছোটনাগপুর প্রজাস্বত্ব আইন পাশ করে আদিবাসীদের জমির অধিকারে সুরক্ষা দেয়।
প্রশ্ন: মুন্ডা বিদ্রোহের অন্যতম ধর্মীয় প্রভাব কী ছিল ?
উত্তর: বিরসা মুন্ডা নিজেই একটি নতুন ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন, যেটিকে “বিরসাইট ধর্ম” বলা হয়।
প্রশ্ন: মুন্ডা বিদ্রোহে বেগার প্রথার ভূমিকা কী ছিল ?
উত্তর: জমিদার ও মহাজনদের কাছে বেগার শ্রম দিতে বাধ্য হওয়াই ছিল বিদ্রোহের একটি প্রধান কারণ। পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার এই প্রথা বাতিল করে।
প্রশ্ন: বিরসা মুন্ডার পরিণতি কী হয় ?
উত্তর: ১৯০০ সালে ব্রিটিশ সরকার বিরসা মুন্ডাকে গ্রেফতার করে এবং জেলে পাঠায়, সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
প্রশ্ন : মুন্ডা বিদ্রোহের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কী?
উত্তর: এটি কেবল জমি বা ধর্মের লড়াই নয়, বরং এক আদিবাসী জাতির অস্তিত্ব, অধিকার ও আত্মপরিচয় রক্ষার লড়াই ছিল। এটি পরবর্তী আদিবাসী ও কৃষক আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে।





