ইতিহাস, দশম শ্রেণী

বাংলায় ছাপাখানার ব্যবসায়িক উদ্যোগ সমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ

Admin

No Comments

বাংলায় ছাপাখানার ব্যবসায়িক উদ্যোগ শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নয়, এটি ছিল ভাষা, সাহিত্য এবং শিক্ষার অগ্রগতির ভিত্তি। এই উদ্যোগগুলি বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

১৮শ শতকের শেষ প্রান্তে কলকাতা বাণিজ্যিক ও সরকারি মুদ্রণের প্রথম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে এই সময়েই প্রথমবার একটি প্রাথমিক বই ব্যবসার কথা বলা সম্ভব হয়, যা পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করেছিল। এই ব্যবসার অন্তর্ভুক্ত ছিল মুদ্রণের কার্যক্রম, বই বাঁধাই, সাবস্ক্রিপশন প্রকাশনা এবং লাইব্রেরির পরিচালনা।

এই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলি ছিল “দ্য ইন্ডিয়া গেজেট (সোমবার), হিকির বেঙ্গল গেজেট (শনিবার), দ্য কলকাতা ক্রনিকল” (মঙ্গলবার), দ্য কলকাতা গেজেট(বৃহস্পতিবার), দ্য এশিয়াটিক মিরর (বুধবার) এবং দ্য রেকর্ডার (রবিবার)।

Table of Contents

বাংলায় ছাপাখানার ব্যবসায়িক উদ্যোগ সমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

ভূমিকাঃ

বাংলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার অল্প কিছুকালের মধ্যেই বাণিজ্যিক উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়। প্রথমদিকে এই উদ্যোগ ইউরোপীয়দের মধ্যে দেখা গেলেও পরের দিকে ছাপাখানা বাঙালীদের একচেটিয়া কারবারে পরিণত হয়। সময়ের হাত ধরে ধীরে ধীরে মুদ্রণশিল্প একটি প্রাতিষ্ঠানিক পেশাদারী ব্যবসা হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। তবে বাংলায় ছাপাখানার ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও এক বিপ্লব সৃষ্টি করেছিল।

হিকির উদ্যোগঃ

জেমস অগাস্টাস হিকি ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে তার ছাপাখানা থেকে কলকাতায় ‘হিকিস বেঙ্গল গেজেট’ নামে প্রথম ইংরেজি পত্রিকা মুদ্রণ করেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক কারনেই হিকি তার সংবাদপত্রটি প্রকাশ করেছিলেন।যদিও এটি বাংলা পত্রিকা ছিল না, তবে হিকির উদ্যোগ বাংলা মুদ্রণ শিল্পে প্রেরণা যুগিয়েছিল।

উইলকিন্সের উদ্যোগঃ

অ্যান্ড্রুজ সাহেবের ছাপাখানা থেকে হ্যালহেডের বাংলা ব্যাকরণ ছাপা হয়েছিল। পরবর্তীকালে এই ছাপাখানাটি কোম্পানি অধিগ্রহণ করলে উইলকিন্স ‘অনারেবল কোম্পানিস প্রেস’ নামে ছাপাখানাটি কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে। এটি ছিল অষ্টাদশ শতকে কলকাতার সবচেয়ে বড় ও সক্রিয় ছাপাখানা। তাঁর উদ্যোগে ‘ভাগবত গীতা’ ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় মুদ্রিত হয়। উইলকিন্সের এই প্রচেষ্টা বাংলার মুদ্রণশিল্পে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়।

গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্যের উদ্যোগঃ

ফ্রেন্ডস অফ ইন্ডিয়া এবং সমাচার দর্পণের তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলা বই বিক্রির জন্য ১৮১৫-১৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ প্রথম দোকান খোলেন গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্য। তিনি ছিলেন বাংলা পুস্তক ব্যবসার পথিকৃৎ। । পরে হরচন্দ্র রায়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ‘বাঙ্গাল গেজেটি প্রেস’ স্থাপন করেন। এই প্রেস থেকে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বাঙালি সম্পাদিত সংবাদপত্র ‘বাঙ্গাল গেজেটি’ তিনি প্রকাশ করেন। গঙ্গা কিশোরই ছিলেন প্রথম বাঙালি ব্যবসায়িক উদ্যোক্তা যিনি ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল‘ ছাপার মধ্যে দিয়ে বাণিজ্যিক আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন।

বটতলা প্রকাশনীর বই ব্যবসাঃ

কলকাতার বটতলা ছিল বাংলা ভাষার বইয়ের একটি জনপ্রিয় ছাপাখানা এলাকা। সস্তায় বই বিক্রির ক্ষেত্রে বটতলা প্রকাশনী একটি প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করেছিল। এই এলাকার ছাপাখানা ও প্রকাশনী থেকে বাংলা ভাষার বিভিন্ন ধরনের বই প্রকাশিত হতো। যেগুলি গ্রামীণ এবং শহুরে জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল।

বাংলায় ছাপাখানার ব্যবসায়িক উদ্যোগ
ছাপাখানা

বিদ্যাসাগরের অবদানঃ

উনিশ শতকে বাংলা প্রকাশনা ও বইয়ের ব্যবসাতে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সর্বাধিক প্রভাব ছিল। বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কার কে সঙ্গে নিয়ে বিদ্যাসাগর ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে পটলডাঙ্গার ৬২ নম্বর আমহার্স্ট স্ট্রিটে ‘সংস্কৃত প্রেস’ নামে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া স্থাপন করেন ‘সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরি‘ (১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দ) এবং ‘কলিকাতা পুস্তকালয়’ (১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ)। ছাপাখানা থেকে তার মাসিক আয় হতো ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। এই বাণিজ্যিক সাফল্যের জন্য বিদ্যাসাগরকে ‘বিদ্যাবণিক‘ এবং আধুনিক বই ব্যবসার প্রথম পথপ্রদর্শক বলা হয়।

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর অবদানঃ

উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ১৮৯৫ সালে ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ভারতে হাফটোন মুদ্রণ পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। তাঁর ছাপাখানা থেকে ‘টুনটুনির বই’ এবং ‘সন্দেশ’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন বাংলা মুদ্রণ শিল্পে বিপ্লব ঘটায়।

শ্রীরামপুর মিশনের বই ব্যবসাঃ

১৮০০ খ্রিস্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশন প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রেস থেকে নানা রকমের বই মুদ্রিত হওয়ার ফলে একটি বাঙালি পাঠক গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়। এর সাথে সাথে বইয়ের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। এখানে ৪৫টি ভাষায় প্রায় ২,১২,০০০ বই মুদ্রিত হয়, যা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছিল।

স্কুলবুক সোসাইটির বই ব্যবসাঃ

বাংলা পুস্তক রচনা এবং বিক্রিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল ‘স্কুলবুক সোসাইটি’। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ‘স্কুলবুক সোসাইটি’ থেকে মাত্র এক বছরে ৬৫ টি বাংলা বই ছেপে বেরিয়েছিল। কলকাতা এবং বিভিন্ন জেলায় বই বিতরণ কেন্দ্র স্থাপন এবং বিক্রিতাজের কমিশনের মাধ্যমে ‘স্কুলবুক সোসাইটি’ আধুনিক রীতিতে বইয়ের ব্যবসা আরম্ভ করেছিল।

উপসংহারঃ

বাংলায় ছাপাখানার ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলি কেবল বই মুদ্রণেই সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং শিক্ষার বিস্তারে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উনিশ শতকে বাঙালির কাছে ছাপাখানা একটি অন্যতম নেশা ও পেশার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এই সময় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার জন্য অনেকে পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে দিতেও কসুর করেননি।

জাতীয়তাবাদ প্রসারে হিন্দুমেলার ভূমিকাঃ প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর দেখতে Click করুন এখানে।

তথ্যসূত্রঃ

এই ব্লগের কাজ করতে Wikipedia, Banglapedia এর সাহায্য নেয়া হয়েছে।

ছাপাখানার ব্যবসায়ী উদ্যোগ থেকে কিছু সংক্ষিপ্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্তরঃ

প্রশ্ন: বাংলায় প্রথম সংবাদপত্র কোনটি এবং কে প্রকাশ করেছিলেন?

উত্তর: বাংলায় প্রথম সংবাদপত্র ছিল “হিকিস বেঙ্গল গেজেট”। এটি জেমস অগাস্টাস হিকি ১৭৮০ সালে প্রকাশ করেছিলেন।

প্রশ্ন: বাংলায় ছাপাখানার ব্যবসায়িক উদ্যোগের সূচনা কীভাবে হয়েছিল?

উত্তর: বাংলায় ছাপাখানার ব্যবসায়িক উদ্যোগের সূচনা ১৭৮০ সালে জেমস অগাস্টাস হিকির মাধ্যমে হয়। তিনি কলকাতায় প্রথম মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান চালু করেন এবং ‘হিকিস বেঙ্গল গেজেট’ নামে উপমহাদেশের প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশ করেন।

প্রশ্ন: বাংলা ভাষায় বই ছাপার ক্ষেত্রে গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্যের অবদান কী ছিল?

উত্তর: গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্য বাংলা পুস্তক ব্যবসার পথিকৃৎ। তিনি ১৮১৫-১৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বাংলা বই বিক্রির জন্য প্রথম দোকান খুলেছিলেন। তিনিই ছিলেন প্রথম বাঙালি ব্যবসায়িক উদ্যোক্তা যিনি ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ ছাপার মধ্যে দিয়ে বাণিজ্যিক আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন।

প্রশ্ন: উইলকিন্সের বাংলা মুদ্রণ শিল্পে অবদান কী ছিল?

উত্তর: চার্লস উইলকিন্স ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে ‘অনারেবল কোম্পানিস প্রেস’ নামে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর উদ্যোগে ‘ভাগবত গীতা’ ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় মুদ্রিত হয়। উইলকিন্সের এই প্রচেষ্টা বাংলার মুদ্রণশিল্পে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়।

প্রশ্ন: বিদ্যাসাগরের উদ্যোগ বাংলা প্রকাশনা শিল্পে কী পরিবর্তন এনেছিল?

উত্তর: বিদ্যাসাগর ‘সংস্কৃত প্রেস’ এবং ‘সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরি’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি শিক্ষামূলক বই মুদ্রণ ও বিক্রির মাধ্যমে বাংলা ভাষার প্রচার এবং শিক্ষা বিস্তারে অবদান রাখেন।

প্রশ্ন: বটতলা প্রকাশনী কেন জনপ্রিয় ছিল?

উত্তর: কলকাতার বটতলা ছিল বাংলা ভাষার বইয়ের একটি জনপ্রিয় ছাপাখানা এলাকা। সস্তায় বই বিক্রির ক্ষেত্রে বটতলা প্রকাশনী একটি প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করেছিল। এই এলাকার ছাপাখানা ও প্রকাশনী থেকে বাংলা ভাষার বিভিন্ন ধরনের বই প্রকাশিত হতো। যেগুলি গ্রামীণ এবং শহুরে জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল।

প্রশ্ন: উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর মুদ্রণ শিল্পে কী অবদান ছিল?

উত্তর: উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী আধুনিক মুদ্রণ প্রযুক্তি প্রবর্তন করেন এবং হাফটোন প্রিন্টিং পদ্ধতি ব্যবহার করেন। তিনি ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ‘টুনটুনির বই’ ও ‘সন্দেশ’ পত্রিকা প্রকাশ করেন।

প্রশ্ন: শ্রীরামপুর মিশনের মুদ্রণ কার্যক্রমের গুরুত্ব কী?

উত্তর: শ্রীরামপুর মিশন প্রেস বাংলা ভাষায় বিভিন্ন ধরনের বই প্রকাশ করেছিল। ১৮০০ থেকে ১৮৩২ সালের মধ্যে এখানে ৪৫টি ভাষায় ২,১২,০০০ বই মুদ্রিত হয়েছিল, যা বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।:

প্রশ্ন: বাণিজ্যিক উদ্যোগ বাংলার ভাষা ও সাহিত্যে কীভাবে অবদান রেখেছিল?

উত্তর: মুদ্রণ ব্যবসায়িক উদ্যোগ বাংলার ভাষা ও সাহিত্যের প্রচার, প্রসার এবং শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি বাংলা ভাষায় নতুন বই লেখার এবং প্রকাশের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করেছিল।

প্রশ্ন: বাংলার ছাপা খানার উদ্যোগগুলি সংস্কৃতিতে কী পরিবর্তন এনেছিল?

উত্তর: বাংলার ছাপাখানার উদ্যোগগুলি শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নয়, এটি ভাষা, সাহিত্য, এবং শিক্ষার অগ্রগতির ভিত্তি তৈরি করেছিল। এটি সাধারণ মানুষের মধ্যে জ্ঞানের প্রচার এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।

আরো পড়ুনঃ

Sharing Is Caring:

Leave a Comment