বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশ শুরু হয় উনিশ শতকের শেষ এবং বিংশ শতকের শুরুর দিকে। মূলত, ভারতে ব্রিটিশদের প্রয়োজনে কারিগরি শিক্ষা সূচনা হয়েছিল।
ব্রিটিশ আমলে কারখানা ও শিল্পায়নের বৃদ্ধির সাথে সাথে দক্ষ কর্মীর চাহিদা বাড়তে থাকে। এই চাহিদা মেটাতে কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয়। তবে স্বাধীনতার পর থেকেই কারিগরি শিক্ষার দিকে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে।
বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও: মান-৮ (M.P-2019)
ভূমিকাঃ
উনিশ শতকের শেষ দিকে বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশ জাতীয় চেতনা, আত্মনির্ভরশীলতা এবং আধুনিক শিল্প-প্রযুক্তির বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। স্বদেশি আন্দোলনের প্রভাব ও ব্রিটিশ শাসনের প্রেক্ষাপটে এ শিক্ষার প্রসার শুরু হয়।
প্রথম উদ্যোগঃ
বাঙালির কারিগরি ইতিহাস ঘাঁটলে প্রথম যে নামটি আসে তিনি হলেন গোলকচন্দ্র। তিনি ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড থেকে আগত বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আদলে প্রথম কারিগরি যন্ত্র তৈরি করেন। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা নিজেদের সামরিক প্রয়োজনে এ দেশে টেলিগ্রাফ লাইন পাতার কাজ শুরু করলে এই বিভাগে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন প্রথম ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার শিবচন্দ্র নন্দী। মহেন্দ্রনাথ নন্দী কাপড় বোনার যন্ত্র প্রস্তুত করেন। অচিরেই বাঙালি কারিগররা আধুনিক কারিগরি প্রযুক্তিবিদ্যা শেখার দিকে মন দেয়।
জাতীয় শিক্ষা পরিষদঃ
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ ই মার্চ জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হয়। যার অন্যতম একটি লক্ষ্য ছিল বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানো। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ই আগস্ট অরবিন্দ ঘোষ কে অধ্যক্ষ করে বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলা এবং বাংলার বাহিরে বোম্বাই, মাদ্রাজ,পাঞ্জাব প্রভৃতি স্থানে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের উদ্যোগে শিক্ষার প্রসার ঘটে। তবে শেষ পর্যন্ত আর্থিক সংকট, সরকারি চাকরি না পাওয়া, ব্রিটিশ সরকারের দ্বিমাত্রিক আচরণ ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ থেকেই এই প্রতিষ্ঠানটির জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে শুরু করে।
বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটঃ
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ শে জুলাই বিশিষ্ট আইনজীবী ও শিক্ষাপ্রেমী তারকনাথ পালিতের উদ্যোগে কলকাতায় ‘বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানে কলা বিভাগের পাশাপাশি পদার্থবিদ্যা,রসায়ন,প্রযুক্তি,শিল্প ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে এই প্রতিষ্ঠানে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সংক্রান্ত শিক্ষার সূচনা হয়। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের নতুন নামকরণ হয় ‘কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি’। ভারতের স্বাধীনতা লাভের পরবর্তীকালে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে এই প্রতিষ্ঠানটি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে পরিচিত পায়।
শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠাঃ
কারিগরি শিক্ষার জন্য প্রয়োজন হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের। তাই শিক্ষার প্রসার ঘটাতে ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ‘ কলকাতা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলেজটি শিবপুরে স্থানান্তরিত হয় । তখন এর নাম হয় ‘বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ‘। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে থেকে এই কলেজ ডিগ্রি প্রদান করতে শুরু করে।
উপসংহারঃ
বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশ জাতীয় শিক্ষার অগ্রগতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি শুধু প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি নয়, বরং দেশীয় চেতনা ও আত্মনির্ভরতার প্রতীক। বর্তমান বাংলার আইআইটি খড়গপুর, আইআইইএসটি শিবপুর ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের শিকড় এ আন্দোলনের মধ্যেই নিহিত।
শ্রীরামপুর মিশন প্রেস কীভাবে একটি অগ্রনী মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল?: সম্পূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেখতে Click করুন এখানে।
তথ্যসূত্রঃ
এই ব্লগের কাজ করতে bengalstudent এর সাহায্য নেয়া হয়েছে।
বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন-উত্তরঃ
প্রশ্ন: বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশ কখন থেকে শুরু হয়?
উত্তর: বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশ উনিশ শতকের শেষ এবং বিংশ শতকের শুরুর দিকে শুরু হয়। এটি মূলত ব্রিটিশদের প্রয়োজন মেটাতে এবং স্বদেশি আন্দোলনের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠনের লক্ষ্যে প্রচারিত হয়।
প্রশ্ন: প্রথম ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাকে মনে করা হয়?
উত্তর: প্রথম ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে শিবচন্দ্র নন্দীকে মনে করা হয়। তিনি ব্রিটিশদের টেলিগ্রাফ লাইন পাতার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
প্রশ্ন: জাতীয় শিক্ষা পরিষদের ভূমিকা কী ছিল?
উত্তর: ১৯০৬ সালে গঠিত জাতীয় শিক্ষা পরিষদের লক্ষ্য ছিল বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার। এটি বেঙ্গল ন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রশ্ন: বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট কবে প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর: বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট ১৯০৬ সালের ২৫শে জুলাই তারকনাথ পালিতের উদ্যোগে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রশ্ন: বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের প্রাথমিক লক্ষ্য কী ছিল?
উত্তর: এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ছিল ছাত্রদের আধুনিক কারিগরি শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল ও দক্ষ করে তোলা।
প্রশ্ন: শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ কবে প্রতিষ্ঠিত হয়?
উত্তর: শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ১৮৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ১৮৫৭ সালে শিবপুরে স্থানান্তরিত হয় এবং পরবর্তীতে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নামে পরিচিতি লাভ করে
প্রশ্ন: কারিগরি শিক্ষার প্রসারে তারকনাথ পালিতের ভূমিকা কী ছিল?
উত্তর: তারকনাথ পালিত বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার মূল উদ্যোক্তা ছিলেন। তিনি আর্থিক ও সাংগঠনিক দিক থেকে এ প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
প্রশ্ন: কারিগরি শিক্ষার উন্নতিতে ব্রিটিশ শাসনের ভূমিকা কী ছিল?
উত্তর: ব্রিটিশ শাসনের সময় কারিগরি শিক্ষা মূলত শিল্প ও সামরিক প্রয়োজনে শুরু হয়। তাদের উদ্যোগেই শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
প্রশ্ন: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিকড় কোথায় নিহিত?
উত্তর: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিকড় বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে নিহিত। ১৯৫৫ সালে এটি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়।
প্রশ্ন: বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশের গুরুত্ব কী?
উত্তর: বাংলায় কারিগরি শিক্ষার বিকাশ জাতীয় উন্নয়ন, আত্মনির্ভরশীলতা ও আধুনিক শিল্প-প্রযুক্তির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এটি বর্তমানের আইআইটি খড়গপুর ও আইআইইএসটি শিবপুরের মতো প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি গড়ে তুলেছে।