আধুনিক ভারতে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব (১৮৩৬-৮৬ খ্রিস্টাব্দে)।
পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার আরামবাগ মহকুমায় অবস্থিত কামারপুকুর গ্রামে ১৮৩৬ সালে এক দরিদ্র ধর্মনিষ্ঠ রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ পরিবারে রামকৃষ্ণ পরমহংসের জন্ম হয়।কথিত আছে, শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মের পূর্বে তাঁর পিতামাতার সম্মুখে বেশ কয়েকটি অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল। সন্তানসম্ভবা চন্দ্রমণি দেবী দেখেছিলেন শিবলিঙ্গ থেকে নির্গত একটি জ্যোতি তাঁর গর্ভে প্রবেশ করছে। তাঁর জন্মের অব্যবহিত পূর্বে গয়ায় তীর্থভ্রমণে গিয়ে ক্ষুদিরাম গদাধর বিষ্ণুকে স্বপ্নে দর্শন করেন। সেই কারণে তিনি নবজাতকের নাম রাখেন গদাধর।১৮৫৯ সালে পঞ্চমবর্ষীয়া বালিকা সারদার সঙ্গে তার শাস্ত্রমতে বিবাহ সম্পন্ন হয়। শ্রীরামকৃষ্ণের বয়স তখন তেইশ।
১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় বিখ্যাত জমিদার রানী শিরোমণ দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণী কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ওই মন্দিরে দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে গদাধর সহকারি পুরোহিত হিসাবে কাজে যোগদান দেন। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে দাদার মৃত্যু হলে গদাধর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত হিসাবে নিযুক্ত হন। এর অল্প কিছুদিন পরই তিনি একজন প্রখ্যাত কালী সাধক হয়ে ওঠেন। এই সময় তিনি তোতাপুরি নামে এক সাধুর কাছে দীক্ষা নেন। তোতাপুরীই গদাধর এর নামকরণ করেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। পরবর্তীকালে এই নামেই তিনি জগতবিখ্যাত ও প্রসিদ্ধ হন।
শ্রীরামকৃষ্ণ ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম সহ বিভিন্ন ধর্মমত অভ্যাস করেছিলেন এবং উপলব্ধি করেছিলেন সকল মতই একই ঈশ্বরের পথে মানুষকে চালিত করে। তাই তিনি ঘোষণা করেন “যত্র জীব তত্র শিব” অর্থাৎ, যেখানেই জীবন, সেখানেই শিবের অধিষ্ঠান।
শ্রীরামকৃষ্ণের ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’-এর আদর্শ ব্যাখ্যা:
ভূমিকা:
আধুনিক ভারতের ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক ব্যক্তিক হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণী মন্দিরের পূজারী শ্রী রামকৃষ্ণ মধ্যযুগীয় কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ ভারতীয় সমাজ ও ধর্মের ত্রুটি বিচ্যুতি গুলি নির্ণয় করে সেগুলি দূর করতে বদ্ধপরিকর হন।
যত মত তত পথ:
ধর্ম নিয়ে সনাতনপন্থীদের সঙ্গে নব্যপন্থীদের যে দ্বন্দ্ব ছিল তার সমন্বয় সাধনের মূর্ত প্রতীক ছিলেন রামকৃষ্ণ।তিনি বুঝিয়েছিলেন সর্বধর্মের সমন্বয় হল যুগের আদর্শ। বৈষ্ণব ও শক্তি সাধনার বিচিত্র পথ, ইসলাম থেকে খ্রিস্টান সাধনা, দ্বৈত থেকে অদ্বৈত, সাকার থেকে নিরাকার,সগুন থেকে নির্গুন সব সাধনার মধ্যে তিনি বিরোধের মীমাংসা ঘটালেন-‘যত মত, তত পথ‘-এই মত দিয়ে। তিনি বলেন মতের ভিত্তিতে পথ আলাদা হলেও লক্ষ্য সবারই এক ঈশ্বরের সান্নিধ্য।
আন্তরিকতার আদর্শ:
শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, ঈশ্বরের জন্য পাণ্ডিত্য, শাস্ত্রজ্ঞান, মন্ত্র-তন্ত্র, জপ-তপ, সংসার ত্যাগ, কৃচ্ছ্বসাধন, যাগ-যজ্ঞ, সুচিতা এসব কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। কেবল ভক্তির সাথে অন্তর দিয়ে যে কেউ ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে পারে।
নিষ্কাম কর্মের আদর্শ:
ঈশ্বর সাধনার জন্য সংসার ত্যাগ করা, কর্ম ত্যাগ করার কথা রামকৃষ্ণদেব বলেননি-তিনি নিষ্কাম কর্মের কথা বলেছেন।
শিবজ্ঞানে জীবসেবা:
শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্তের মতবাদ কি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন জীবসেবা ও মানবসেবাই হল ঈশ্বরের সেবা। তার মতে,জীবই হল শিব-‘যত্র জীব তত্র শিব‘। জীব সেবার আদর্শ প্রচার করে রামকৃষ্ণ সর্ব ধর্মের আদর্শকে মজবুত করেন।
ধর্মীয় আদর্শ:
সংকীর্ণতা ও কোলাহলের দিনে রামকৃষ্ণ মানব মহিমার জয়গান করেন। মানুষের মহত্ত্বে বিশ্বাসী রামকৃষ্ণ মনে করতেন-প্রত্যেক মানুষই অনন্ত শক্তির আধার, তা সে যে ধর্মেরই হোক না কেন। তিনি আরো বলেন চৈতন্যের পথে অগ্রসর হওয়াই মানুষের ধর্ম।
সরল আদর্শ:
শ্রীরামকৃষ্ণ তার আদর্শ খুব সরল ভাষায় বিভিন্ন গল্পের উপমা দিয়ে মানুষের কাছে তুলে ধরতেন। সমাজের নিচে তলা বা উপরতলার সব ধরনের মানুষই তার মুখ থেকে ধর্মের আদর্শ শোনার জন্য তার কাছে ছুটে আসতেন।
উপসংহার:
বলা যায়, ধর্ম এবং ধর্মীয় গোড়ামীতে শতধা বিভক্ত সহস্র বছরের ভারতকে শ্রী রামকৃষ্ণ সর্বপ্রথম সহিষ্ণুতার, সমন্বয়ের এবং সহনশীলতার শিক্ষা দিয়েছিলেন। এই শিক্ষায় পরবর্তীকালে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। এছাড়া তার সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শ বিকশিত হয়ে ধর্মনিরপেক্ষ ভারত গড়ে উঠেছে।
পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে রামমোহন রায়ের ভূমিকা: প্রশ্নের উত্তরটি দেখতে Click করুন এখানে।
তথ্যসূত্র:
এই ব্লগের কাজ করতে Wikipedia এর সাহায্য নেয়া হয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ ও তার সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শ সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন-উত্তর:
প্রশ্ন: রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব কে ছিলেন?
উত্তর: রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব আধুনিক ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে হুগলি জেলার কামারপুকুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর শিক্ষা ও কর্মধারা ভারতীয় ধর্মীয় ঐতিহ্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।
প্রশ্ন: কেন তাঁকে ‘গদাধর’ নামকরণ করা হয়?
উত্তর: শ্রীরামকৃষ্ণের পিতামাতা তাঁর জন্মের পূর্বে স্বপ্নে বিষ্ণু গদাধর দর্শন করেন। এই কারণে নবজাতকের নাম রাখা হয় গদাধর।
প্রশ্ন: রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব কীভাবে কালী সাধক হয়ে ওঠেন?
উত্তর: দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী কালী মন্দিরে পুরোহিত হওয়ার পর তিনি কালী সাধনায় ব্যাপৃত হন এবং ধীরে ধীরে একজন প্রখ্যাত কালী সাধকে পরিণত হন।
প্রশ্ন: ‘যত মত তত পথ’ কথাটির অর্থ কী?
উত্তর: ‘যত মত তত পথ’ দ্বারা শ্রী রামকৃষ্ণ বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, বিভিন্ন ধর্ম বা মত পথ পৃথক হলেও সবার লক্ষ্য এক, তা হলো ঈশ্বরের সান্নিধ্য।
প্রশ্ন: রামকৃষ্ণের ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’ ধারণার অর্থ কী?
উত্তর: শিবজ্ঞানে জীবসেবা বলতে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, প্রত্যেক জীবের মধ্যেই শিব বা ঈশ্বর বিরাজমান। তাই জীবসেবা মানেই ঈশ্বরের সেবা।
প্রশ্ন: রামকৃষ্ণের মতে ঈশ্বর সাধনার জন্য কী প্রয়োজন?
উত্তর: রামকৃষ্ণের মতে ঈশ্বর সাধনার জন্য জ্ঞান, মন্ত্র-তন্ত্র, বা কঠোর তপস্যার প্রয়োজন নেই, বরং আন্তরিক ভক্তি ও সরল মনোভাবই যথেষ্ট।
প্রশ্ন: ‘নিষ্কাম কর্ম’ কী এবং এটি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
উত্তর: ‘নিষ্কাম কর্ম’ হলো স্বার্থহীনভাবে কাজ করা। শ্রী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস করতেন যে, কর্ম ত্যাগ না করেও ঈশ্বর সাধনা করা সম্ভব যদি তা নিষ্কামভাবে করা হয়।
প্রশ্ন: শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের ধর্মীয় আদর্শ কি ছিল?
উত্তর: শ্রী রামকৃষ্ণ বিশ্বাস করতেন যে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে চৈতন্য রয়েছে এবং মানুষের মহত্ত্বকে তিনি ঈশ্বরের অংশ হিসেবে দেখতেন। তিনি সংকীর্ণতাকে ত্যাগ করে মানুষকে চৈতন্যের পথে অগ্রসর হওয়ার উপদেশ দেন।
প্রশ্ন: রামকৃষ্ণ কীভাবে তাঁর আদর্শ প্রচার করতেন?
উত্তর: তিনি সাধারণ ও সরল ভাষায় গল্প এবং উপমা ব্যবহার করে তাঁর ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক আদর্শ প্রচার করতেন, যা সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে সহজবোধ্য ছিল।
প্রশ্ন: রামকৃষ্ণের সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শের প্রভাব কী ছিল?
উত্তর: তাঁর সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শ ভারতে সহিষ্ণুতা, সমন্বয় এবং ধর্মনিরপেক্ষতার বীজ বপন করে, যা পরবর্তীকালে একটি ঐক্যবদ্ধ ও সহনশীল ভারত গঠনে সহায়ক হয়েছে।