গান্ধী আম্বেদকর বিতর্কের মূল বিষয় ছিল দলিতদের অধিকার, বর্ণ প্রথা, রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ইত্যাদি বিষয়ে।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশাপাশি সামাজিক ন্যায়বিচার ও নিম্নবর্ণের অধিকার আদায়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন মহাত্মা গান্ধী ও ড. বি. আর. আম্বেদকর। কিন্তু দলিত আন্দোলন ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের বিষয়ে তাদের মধ্যে তীব্র মতপার্থক্য ছিল।
দলিত আন্দোলন বিষয়ে গান্ধী আম্বেদকর বিতর্ক বিশ্লেষণ কর।
ভূমিকাঃ
মহাত্মা গান্ধী এবং বি আর আম্বেদকর উভয়েই ভারতীয় সমাজে দলিতদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছেন, তবে তাদের পন্থা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু মৌলিক পার্থক্য ছিল। এই পার্থক্যগুলো নিয়ে তাদের মধ্যে বিতর্কও হয়েছে। এই বিতর্কগুলি সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
গান্ধী আম্বেদকর বিতরকে সূত্রপাতঃ
ভারতের জাতিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় “অস্পৃশ্য” বা দলিতদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার ছিল অত্যন্ত সীমিত। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে কংগ্রেস দলের প্রতিনিধি মহাত্মা গান্ধী ও দলিত শ্রেণীর প্রতিনিধি ডঃ ভিমরাও জি আম্বেদকর অংশ নেন। এই বৈঠকে দলিতদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিয়ে গান্ধী ও আম্বেদকরের মধ্যে প্রধান বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
বিতর্কের মূল বিষয়ঃ
আম্বেদকর মনে করতেন, হিন্দু সমাজের বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা সমাজে প্রচলিত অস্পৃশ্যতার মূল কারণ। এজন্য তিনি দলিতদের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সত্তা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় জোর দেন। অন্যদিকে গান্ধীজি ছিলেন বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার সমর্থক এবং অস্পৃশ্যতার বিরোধী । তিনি মনে করতেন বর্ণাশ্রম ব্যবস্থাকে অক্ষুন্য রেখে অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ ও দলিতদের কল্যাণ সম্ভব। এজন্য তিনি “অস্পৃশ্যতা নিবারণ আন্দোলন” শুরু করেন এবং দলিতদের মন্দির প্রবেশের অধিকার দেওয়ার জন্য প্রচার চালান। তিনি দলিদের ‘হরিজন’ বা ‘ঈশ্বরের সন্তান’ বলে আখ্যা দেন।
পৃথক নির্বাচনের দাবিঃ
আম্বেদকর সংখ্যালঘু দলিতদের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য চেয়েছিলেন পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা, যাতে তারা নিজেদের প্রতিনিধি বেছে নিতে পারে। অন্যদিকে গান্ধীজী দাবি করেন দলিতরা সংখ্যালঘু নয় তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের অংশ। তাই পৃথক নির্বাচন হলে হিন্দু সমাজ বিভক্ত হবে এবং দলিতরা প্রধান সমাজ থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এজন্য তিনি পৃথক নির্বাচনে অধিকার দানের বিরোধিতা করেন।
পুনা চুক্তিঃ
এই পরিস্থিতিতে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রামসে ম্যাকডোনাল্ড হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য ‘সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা‘ নীতি ঘোষণা করেন। এই নীতির মাধ্যমে দলিতসহ বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে পৃথক নির্বাচনের অধিকার দেওয়া হলে আম্বেদকর সমর্থন করেন। অন্যদিকে গান্ধীজী ঘেরওয়াদা জেলে আমরণ অনশন শুরু করেন। প্রথমদিকে আম্বেদকর নিজ দাবিতে অনড় থাকলেও গান্ধীজীর প্রাণ সংশয় দেখা দিলে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে উভয়ের মধ্যে পুনা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্যে দিয়ে আম্বেদকর পৃথক নির্বাচনের দাবি থেকে সরে আসেন। গান্ধী আম্বেদকর বিতর্কের অবসান হয়।
উপসংহারঃ
এই বিতর্কগুলো থেকে দেখা যায় যে গান্ধী ও আম্বেদকর উভয়েই দলিতদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করলেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মপন্থা ভিন্ন ছিল। গান্ধী জাতিভেদ প্রথার সংস্কারের মাধ্যমে দলিতদের উন্নতি চেয়েছিলেন, অন্যদিকে আম্বেদকর জাতিভেদ প্রথার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি এবং দলিতদের জন্য রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের মুক্তি চেয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা ভাবনার সমালোচনা: প্রশ্নের সম্পূর্ণ উত্তর দেখতে Click করুন এখানে।
তথ্যসূত্রঃ
এই ব্লগের কাজ করতে Linkedin এর সাহায্য নেওয়া হয়েছে।
দলিত আন্দোলন ও গান্ধী আম্বেদকর বিতর্ক থেকে কিছু aসংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তরঃ
প্রশ্ন: গান্ধী দলিতদের কী নামে ডাকতেন এবং কেন?
উত্তর: গান্ধী দলিতদের ‘হরিজন’ বা ‘ঈশ্বরের সন্তান’ বলে ডাকতেন, কারণ তিনি মনে করতেন যে সমাজে তাদের প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে, তা ঈশ্বরের দৃষ্টিতে অন্যায়।
প্রশ্ন: পুনা চুক্তি কত সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল?
উত্তর: ১৯৩২ সালে আম্বেদকর এবং গান্ধীর মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা পুনা চুক্তি নামে পরিচিত।
প্রশ্ন: দলিত কাদের বলা হত?
উত্তর: হিন্দু সমাজের চতুর বর্ণের বাহিরে পঞ্চম বর্ণের মানুষদের দলিত হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এদের মধ্যে ছিলেন চামার, নাদার, মাহার, নমঃশূদ্র, রাজবংশী প্রভৃতি জনগোষ্ঠী।
প্রশ্ন: দলিত আন্দোলনের প্রধান নেতা কে ছিলেন?
উত্তর: দলিত আন্দোলনের প্রধান নেতা ছিলেন-ডঃ বি. আর. আম্বেদকর।
প্রশ্ন: পশ্চিম ভারতে দলিত আন্দোলনের পথপ্রদর্শক কে ছিলেন?
উত্তর: পশ্চিম ভারতের দলিত আন্দোলনের পথপ্রদর্শক ছিলেন-মহারাষ্ট্রের জ্যোতিরাও ফুলে।
প্রশ্ন: দক্ষিণ ভারতের দলীত আন্দোলন কে কে প্রসারিত করেছিলেন?
উত্তর: দক্ষিণ ভারতের দলিত আন্দোলনকে প্রসারিত করেছিলেন-শ্রী নারায়ণ গুরু।
প্রশ্ন: ভাইকম সত্যাগ্রহ কবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল?
উত্তর: ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে শ্রী নারায়ণ গুরুর উদ্যোগে কেরালার মালাবার উপকূলে ভাইকম সত্যাগ্রহ শুরু হয়েছিল।
প্রশ্ন: ‘ভারত লেবার পার্টি’ (১৯৩৫) ও ‘সারা ভারত তপশিলি সম্প্রদায়ের ফিডারেশন’ (১৯৪২) কে গড়ে তোলেন?
উত্তর: ডঃ বি. আর. আম্বেদকর।
প্রশ্ন: নমঃশূদ্র আগে কি নামে পরিচিত ছিল?
উত্তর: নমঃশূদ্রের আগে ‘চন্ডাল’ নামে পরিচিত ছিল।
প্রশ্ন: মতুয়া নামে কারা পরিচিত?
উত্তর: হরিচাঁদ ঠাকুরের অনুগামীরা মতুয়া নামে পরিচিত।