সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ(১৭৬৩-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ)ঔপনিবেশিক আমলে সংগঠিত সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী কৃষক বিদ্রোহ।এই বিদ্রোহ প্রায় ৩৭ বছর ধরে চলেছিল।এই বিদ্রোহ ছিল কোম্পানির শাসন শোষণের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ।
১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় ইংরেজ কুঠি আক্রমণের মধ্যে দিয়ে এই বিদ্রোহর সূচনা হয়। পরে দাবানলের মত মালদা, কোচবিহার, রাজশাহী, ফরিদপুর, রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ অর্থাৎ বর্তমান উত্তরবঙ্গ, বিহার ও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
‘গিরি‘ ও ‘দশনামি‘ সম্প্রদায়ভুক্ত সন্ন্যাসী এবং ‘মাদারী‘ সম্প্রদায়ভুক্ত ফকিরদের নেতৃত্বে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ হয়েছিল। এই বিদ্রোহের বর্ণনা পাওয়া যায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ‘ ও ‘দেবী চৌধুরানী‘ উপন্যাসে। ওয়ারেন হেস্টিংস সর্বপ্রথম সন্ন্যাসী বিদ্রোহ কথাটি ব্যবহার করেছিলেন।
সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের ঐতিহাসিক তাৎপর্যঃ
ভূমিকাঃ
অষ্টাদশ শতকে বা তার আগে সন্ন্যাসী ও ফকিরা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াতেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ বাংলা ও বিহারে স্থায়ীভাবে বসবাস করত এবং কৃষিকাজ, মসলা, সিল্ক প্রভৃতির ব্যবসাকে তারা পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিল। ওয়ারেন হেস্টিং এর সময় নতুন ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থায় এরা কোম্পানির শাসন শোষণের শিকার হয়। এর প্রতিবাদে তারা বিদ্রোহের পথে পা বাড়িয়েছিল।
প্রথম কৃষক বিদ্রোহ:
সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ছিল উপনিবেশিক আমলে সংগঠিত ধর্মীয় ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত ভারতের প্রথম কৃষক বিদ্রোহ।
স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামঃ
জাতি ধর্ম নির্বিশেষে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে প্রথম এই বিদ্রোহে সামিল হয়েছিল এবং নেতৃত্ব দিয়েছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল কোম্পানির শাসনের হাত থেকে মুক্তি, তাই অনেকের সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহকে স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম বলেছেন।
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের অগ্রদূতঃ
অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে সংগঠিত বিদ্রোহ ও আন্দোলন গুলির মধ্যে সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ ছিল ভারতের প্রথম সশস্ত্র সংগ্রাম। তাই এই বিদ্রোহকে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের অগ্রদূত বলা হয়। এই বিদ্রোহে প্রথম গেরিলা পদ্ধতি অনুসৃত হয়েছিল।
গন বিদ্রোহঃ
সন্ন্যাসী ও ফকিরা এই বিদ্রোহ শুরু করলেও বহু সাধারণ গ্রামের মানুষ সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহে শামিল হয়েছিল। এছাড়া এই বিদ্রোহ বাংলা বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহকে গণবিদ্রোহ বলা চলে।
জাতীয়তাবোধঃ
সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের আদর্শ পরবর্তীকালের সাহিত্য জগতকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। এই বিদ্রোহের বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করে বঙ্কিমচন্দ্র ‘আনন্দমঠ’ ও ‘দেবী চৌধুরানী’ উপন্যাস রচনা করেছিলেন। যা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে জাতীয়তাবোধের মূলমন্ত্র হয়ে উঠেছিল
সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ ব্যর্থতার কারণঃ
ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রায় দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে চলা সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ বিভিন্ন কারণে ব্যর্থ হয়েছিল-
সুনিয়ন্ত্রিত নেতৃত্বের অভাবঃ
ইংরেজ সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে সাংগঠনিক দুর্বলতা ও সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাব সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহকে ব্যর্থ করেছিল।
আধুনিক অস্ত্রের অভাবঃ
ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো উন্নত অস্ত্রের অভাব বিদ্রোহীদের দুর্বল করে তুলেছিল।
যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতাঃ
অউন্নত যানবাহন ও দুর্গম রাস্তাঘাটের জন্য এক প্রান্তের বিদ্রোহীদের পক্ষে অন্য প্রান্তে গিয়ে বিদ্রোহীদের যুদ্ধে সাহায্য করা সম্ভব হয়নি।
সাম্প্রদায়িক বিভেদঃ
ধর্মীয় বিষয়কে কেন্দ্র করে বিদ্রোহীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ পেয়েছিল। ফলে তাদের মধ্যে মতানৈক দেখা দিয়েছিল যা তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল।
ইংরেজদের উন্নত রণকৌশলঃ
সামরিক দিক থেকে ইংরেজরা অনেক উন্নত ছিল।, তাদের আগ্নেয়াস্ত্রের কাছে সন্ন্যাসী ও ফকিরদের পেরে ওঠা সম্ভব ছিল না। এ ছাড়া ক্যাপ্টেন গ্রান্ড, রেনেল, উন্ডিং ও লেফটেনান্ট কিথ, ক্রিস্টি, মরিসন বিদ্রো দমনে যথেষ্ট তৎপর হয়েছিল।
উপসংহারঃ
সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ বাংলার ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, যা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রথম সংগঠিত প্রতিরোধ। যদিও এটি ব্যর্থ হয়েছিল, কিন্তু এটি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে একটি অগ্রদূত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণের ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’-এর আদর্শ ব্যাখ্যা কর: প্রশ্নের উত্তরটি দেখতে Click করুন এখানে।
তথ্যসূত্র:
এই ব্লগের কাজ করতে Wikipedia এর সাহায্য নেয়া হয়েছে।
সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর:
প্রশ্ন: সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহের কয়েকজন নেতার নাম লেখ?
উত্তর: ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানী, চিরাগ আলী, মুসা শাহ, মজনু শাহ, নুরুল মোহাম্মদ প্রমুখ।
প্রশ্ন: ফকির বিদ্রোহের জনক কাকে বলা হয়?
উত্তর: মজনু শাহ কে ফকির বিদ্রোহের জনক বলা হয়।
প্রশ্ন: সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহের অন্যতম নেতা কে ছিলেন?
উত্তর: দেবী চৌধুরানী।
প্রশ্ন: সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ কোথায় কোথায় সংঘটিত হয়েছিল?
উত্তর: এই বিদ্রোহ মালদা, কোচবিহার, রাজশাহী, ফরিদপুর, রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহসহ বাংলার উত্তরাঞ্চল এবং বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল।
প্রশ্ন: সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ কবে সংঘটিত হয়েছিল?
উত্তর: সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল ১৭৬৩-১৮০০ খ্রিস্টাব্দে।
প্রশ্ন: কার আমলে সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল
উত্তর: ওয়ারেন হেস্টিংস এর আমলে।
প্রশ্ন: কোন উপন্যাস থেকে সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহের বিবরণ পাওয়া যায়?
উত্তর: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘আনন্দমঠ’ এবং ‘দেবী চৌধুরানী’ উপন্যাস থেকে এই বিদ্রোহের বিবরণ পাওয়া যায়।
প্রশ্ন: ‘সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’ কথাটি প্রথম কে ব্যবহার করেন
উত্তর: ওয়ারেন হেস্টিংস সন্ন্যাসী বিদ্রোহ কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন।
প্রশ্ন: কোন সম্প্রদায় ভুক্ত সন্ন্যাসী ও ফকির দের নেতৃত্বে সন্ন্যাসী- ফকির বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল?
উত্তর: ‘গিরি’ও ‘দশনামি’ সম্প্রদায় ভুক্ত সন্ন্যাসী এবং ‘মাদারি’ সম্প্রদায়ভক্ত ফকিরদের নেতৃত্বে সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ হয়েছিল।
প্রশ্ন: সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহের সূচনা কোথায় হয়েছিল?
উত্তর: ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় সন্ন্যাসীরা প্রথম ইংরেজ কুঠির এর উপর আঘাত করে সন্ন্যাসী ফকির বিদ্রোহ সূচনা করেছিল।