মানুষ প্রকৃতি ও শিক্ষার সমন্বয়ে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে এমন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন যেখানে শিক্ষার্থীরা মুক্ত পরিবেশে জ্ঞান অর্জন করতে পারে।
ব্রিটিশ ভারতে প্রচলিত ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে শিক্ষার্থীর প্রাণের কোন সম্পর্ক ছিল না বলে রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন । তাঁর মতে দেশের সাধারণ মানুষ ও প্রকৃতিচর্চা ভিন্ন শিক্ষালাভ অসম্পূর্ণ । রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, শিক্ষার মূল লক্ষ্য হবে শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও কল্পনার অবাধ বিকাশ ঘটানো এবং সেই সঙ্গে তার আত্ম উপলব্ধি তৈরি করা । মানুষের মনের অভ্যন্তরের মানুষটিকে পরিচর্চা করে খাঁটি মানুষ বানানোর প্রচেষ্টাই শিক্ষা । ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’ নামক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন— এই পড়াটাই শেখা এই ধারণা যেন ছাত্রের মধ্যে না জন্মায়, শিক্ষা হবে প্রতিদিনের জীবনযাত্রার একটি অঙ্গ, চলবে তার সঙ্গে একতালে এবং এক সুরে ।
মানুষ প্রকৃতি ও শিক্ষার সমন্বয় বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের চিন্তা এবং শান্তিনিকেতন ভাবনার বিবরণ দাও। (M.P-2018,2020)
ভূমিকাঃ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা দর্শন মূলত মানুষের সর্বাঙ্গীন বিকাশের উপর গুরুত্বারোপ করে। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রকৃতি ও শিক্ষার নিবিড় সংযোগ মানুষের সৃজনশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশে সহায়ক। তার শিক্ষা দর্শনের অন্যতম প্রতীক হলো শান্তিনিকেতন, যা প্রকৃতির কোলে মুক্ত ও সৃজনশীল শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তোলার একটি প্রচেষ্টা।
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনার মূল কথাঃ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, শিক্ষা মানে কেবল জ্ঞান অর্জন নয়; বরং শিক্ষার মাধ্যমে শিশুর মনন, হৃদয় ও আত্মার বিকাশ ঘটে। তার শিক্ষা ভাবনার প্রধান বৈশিষ্ট্য- প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সংযোগ, আনন্দময় ও স্বাধীন শিক্ষা, মানবিক ও বৈশ্বিক চেতনার প্রসার, সৃজনশীলতার উন্নয়ন ।
ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার সমালোচনাঃ
ঔপনিবেশিক শিক্ষাকে রবীন্দ্রনাথ কঠোরভাবে সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, এই শিক্ষা পদ্ধতি শুধু ‘ক্লার্ক‘ তৈরি করে, যা মানবিকতার বিকাশে প্রতিবন্ধক। তার মতে, এটি শৃঙ্খলাবদ্ধ ও যান্ত্রিক, যেখানে সৃজনশীলতার কোনো স্থান নেই। তিনি এই ব্যবস্থার পরিবর্তে এমন শিক্ষার কথা বলেন, যা শিশুদের মনের দরজা খুলে দেয় এবং তাদের সৃজনশীলতা প্রসারিত করে।
শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠাঃ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিক্ষা সম্পর্কে তার ‘প্রকৃতি ভাবনার’ বাস্তবায়ন ঘটাতে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন শান্তিনিকেতন। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর রায়পুরের ভুবনমোহন সিংহের কাছ থেকে ভুবনডাঙ্গা গ্রামে কুড়ি বিঘা জমি কিনে প্রথমে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালে ওই স্থানই তার শিক্ষা ভাবনাকে রূপায়িত করবার জন্য এর নতুন নামকরণ করেন শান্তিনিকে।
ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠাঃ
১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ২২শে ডিসেম্বর, বোলপুরের নিকটবর্তী ভুবনডাঙ্গায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেন শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম বা পাঠভবন স্কুল। শান্তিনিকেতনে উন্মুক্ত প্রাঙ্গনে, খোলা আকাশের নিচে রবীন্দ্রনাথ এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। শিশুরা যাতে মারধর বা কড়া শাসনের কারণে শিক্ষাকে ভয় না পায়, সেটাই ছিল এই বিদ্যালয় এর উদ্দেশ্য।
প্রকৃতির কোলে শিক্ষাঃ
রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, শিক্ষার পরিবেশ কখনই চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে পারে না। কারন প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কখনোই শিক্ষা সম্পূর্ণতা লাভ করতে পারে না।তিনি বলেন, শিশুদের প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা তাদের মানসিক, শারীরিক ও বৌদ্ধিক বিকাশে সহায়ক। এই জন্য তিনি শান্তিনিকেতনে খোলা আকাশের নিচে এবং উন্মুক্ত প্রকৃতির কোলে ব্রম্ভ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে প্রকৃতির কোলে শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন।
প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সমন্বয়ঃ
মুক্তচিন্তার বিকাশের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ‘শিক্ষার মিলন’ শীর্ষ প্রবন্ধে পাশ্চাত্যের শিক্ষা ও আদর্শের সঙ্গে ভারতীয় আদর্শের সমন্বয়ের কথা বলেন। তিনি পাশ্চাত্য জগতের জ্ঞান ভান্ডারকে আয়ত্ত করার আহ্বান জানান।
আনন্দময় শিক্ষাঃ
রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, শিক্ষা হবে শিশুর কাছে আনন্দদায়ক। শিশুরা উন্মুক্ত পরিবেশে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে। তাই খাচায় বন্দী স্কুল বাদ দিয়ে প্রকৃতির উন্মুক্ত পরিবেশে শিশুদের শিক্ষার কথা ভেবেছিলেন। জাতির শিশুরা খেলতে খেলতে শিখতে পারে, প্রকৃতির অপরূপ ঋতু বৈচিত্র্যকে উপলব্ধি করে তারা নিজেদের হৃদয়ে মনের বিকাশ ঘটাতে পারে।
বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠাঃ
১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল তার বৈশ্বিক শিক্ষার স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা।বিশ্বভারতী ছিল এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে বিশ্বমানব তৈরির লক্ষ্যে জ্ঞানের সর্বত্র বিস্তার ঘটানো হয়।এখানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিক্ষার সমন্বয় ঘটানোর পাশাপাশি শিল্প, সাহিত্য, সংগীত ও নাটকের চর্চা হতো।
শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠাঃ
শান্তিনিকেতনের পাশে রবীন্দ্রনাথ ১৯২২ সালে শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন।এটি ছিল একটি গ্রামীণ পুনর্গঠন কেন্দ্র, যেখানে কৃষি, হস্তশিল্প ও কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হতো।শ্রীনিকেতন গ্রামীণ সমাজের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
উপসংহারঃ
রবীন্দ্রনাথের মানুষ, প্রকৃতি ও শিক্ষার সমন্বয় চিন্তা ভারতীয় শিক্ষাক্ষেত্রে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এনেছিল। শান্তিনিকেতন এই দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তব রূপ, যা শুধু শিক্ষার মাধ্যমে নয়, মানবিকতার প্রসারে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে। যদিও এর সীমাবদ্ধতা ছিল, তবুও তার শিক্ষা ভাবনা আজও শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক এবং অনুপ্রেরণামূলক।
বাংলায় ছাপাখানার বিকাশে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভূমিকা: সম্পূর্ণ উত্তরটি দেখতে Click করুন এখানে ।
তথ্যসূত্রঃ
এই ব্লগের কাজ করতে Wikipedia সাহায্য নেয়া হয়েছে
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা চিন্তা এবং শান্তিনিকেতন ভাবনা থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন-উত্তরঃ
প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা দর্শনের মূল ভিত্তি কি ছিল?
উত্তর: রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা দর্শনের মূল ভিত্তি ছিল মানুষ, প্রকৃতি ও শিক্ষার সমন্বয়। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রকৃতির সান্নিধ্যে মুক্ত পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণ করলে শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীন বিকাশ ঘটে।
প্রশ্ন: শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য কি ছিল?
উত্তর: শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি শিক্ষা পরিবেশ তৈরি করা যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রকৃতির কোলে আনন্দময় ও স্বাধীনভাবে জ্ঞান অর্জন করতে পারে, যা গতানুগতিক ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিপরীত।
প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে কিভাবে মূল্যায়ন করেছেন?
উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি মনে করতেন এই শিক্ষা ব্যবস্থা শুধু কেরানি তৈরি করে, যা মানবিকতা ও সৃজনশীলতার বিকাশে বাধা দেয়।
প্রশ্ন: ব্রহ্মচর্যাশ্রম কি এবং এর তাৎপর্য কি?
উত্তর: ব্রহ্মচর্যাশ্রম হলো শান্তিনিকেতনের একটি অংশ, যা ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখানে বৈদিক শিক্ষা পদ্ধতির আদলে প্রকৃতির কোলে শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এর তাৎপর্য হলো শিশুদের মারধর ও কড়া শাসনের ভয় থেকে মুক্ত করে আনন্দময় পরিবেশে শিক্ষা দেওয়া।
প্রশ্ন: বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য কি ছিল?
উত্তর: বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিক্ষার সমন্বয় ঘটিয়ে বিশ্বমানব তৈরি করা। এখানে শিল্প, সাহিত্য, সংগীত ও নাটকের চর্চার মাধ্যমে জ্ঞানের বিস্তার ঘটানো হয়।
প্রশ্ন: শ্রীনিকেতন কেন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল?
উত্তর: শ্রীনিকেতন ১৯২২ সালে শান্তিনিকেতনের পাশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটি ছিল একটি গ্রামীণ পুনর্গঠন কেন্দ্র, যেখানে কৃষি, হস্তশিল্প ও কারিগরি শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে গ্রামীণ সমাজের উন্নয়নে কাজ করা হতো।
প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনায় প্রকৃতির ভূমিকা কি?
উত্তর: রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন শিক্ষা কখনোই চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে পারে না। প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শিক্ষা সম্পূর্ণতা লাভ করতে পারে না। প্রকৃতির সান্নিধ্যে শিশুদের মানসিক, শারীরিক ও বৌদ্ধিক বিকাশ ঘটে।
প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথ কিভাবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিক্ষার সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছিলেন?
উত্তর: রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য জগতের জ্ঞান ভাণ্ডারকে আয়ত্ত করার আহ্বান জানান এবং একই সাথে ভারতীয় আদর্শ ও সংস্কৃতির সমন্বয়ের কথা বলেন। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি এই সমন্বয়ের বাস্তব রূপ দেন।
প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথের মতে আনন্দময় শিক্ষা কি?
উত্তর: রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন শিক্ষা হবে শিশুর কাছে আনন্দদায়ক। শিশুরা খেলাধুলা ও প্রকৃতির সান্নিধ্যে স্বাধীনভাবে শিখবে, এটাই আনন্দময় শিক্ষা।
প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা দর্শনের মূল প্রভাব কি?
উত্তর: রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা দর্শন ভারতীয় শিক্ষাক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এটি শুধু শিক্ষার মাধ্যমে নয়, মানবিকতার প্রসারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং আজও প্রাসঙ্গিক ও অনুপ্রেরণামূলক।