ইতিহাস, দশম শ্রেণী

1857-এর বিদ্রোহকে কি সামন্ত শ্রেণীর বিদ্রোহ বলা যায়?

Admin

No Comments

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র নির্ণয়ে বিভিন্ন তত্ত্ব উঠে আসে। তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘সামন্ত শ্রেণীর বিদ্রোহ’তত্ত্ব।

Table of Contents

১৮৫৭-এর বিদ্রোহ কি সামন্ত শ্রেণীর বিদ্রোহ?

ভূমিকাঃ

১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম বৃহৎ সশস্ত্র আন্দোলন। এটি বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন প্রকৃতি ধারণ করেছিল। তাই এর প্রকৃতি সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়। কেউ একে কৃষক বিদ্রোহ, কেউ ধর্মীয় আন্দোলন, আবার কেউ সামন্ত শ্রেণীর বিদ্রোহ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তবে এই বিদ্রোহে সামন্ত শ্রেণীর ভূমিকা কেমন ছিল তা আমরা বিশ্লেষণ করবো।

A. সামন্ত বিদ্রোহের পক্ষে যুক্তিঃ

ড.রমেশ চন্দ্র মজুমদার, রজনীকান্ত দত্ত, জওহরলাল নেহেরু, ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে সামন্ত শ্রেণীর বিদ্রোহ বলেছেন। ড.রমেশ চন্দ্র মজুমদার এর মতে-এই বিদ্রোহ ছিল সামন্ততন্ত্রের ‘মৃত্যু কালীন আর্তনাদ’।জওহরলাল নেহেরু তার ‘Discovery of India’ গ্রন্থে ১৮৫৭ র বিদ্রোহকে সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

উচ্ছেদ কিত জমিদার ও নবাবদের অংশগ্রহণঃ

ইংরেজদের ভূমি অধিগ্রহণ এবং সামন্ত প্রথা বিলোপের ফলে অনেক জমিদার ও নবাবরা তাদের প্রভাব হারান। তারা নিজেদের ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য বিদ্রোহে সক্রিয় ভূমিকা নেন। যেমন লক্ষ্ণৌর বেগম হাজরত মহল, কানপুরের নানাসাহেব এবং ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই প্রমুখ।

প্রাথমিক নেতৃত্ব:

জুডিথ ব্রাউন এর মত, এই বিদ্রোহে সামন্তরাই নেতৃত্ব দেন এবং সামন্তরাই এই বিদ্রোহে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকারী ছিলেন। নানা সাহেব, লক্ষ্মীবাঈ, হযরত মহল, কোনুয়ার সিং এই সামন্ত শ্রেণীর অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন। স্থানীয় কৃষক, সাধারণ জনগণ তাদের প্রতি আনুগত্য জানান।

ধর্মীয় গোড়ামীঃ

বিদ্রোহীরা সিংহাসনচ্যুত মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ‘ভারতের সম্রাট’ ঘোষণা করে পুরাতন মধ্যযুগীয় শাসনব্যবস্থা কে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল। বিদ্রোহীদের মধ্যে ছিল অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, মধ্যযুগীয় ধর্মীয় উন্মাদনা। এই সমস্ত সমঝতান্ত্রিক প্রবণতা গুলোই প্রমাণ করে খহিষ্ণু সামন্ত প্রভুরা পুনরায় জেগে ওঠার একটা প্রচেষ্টা চালিয়েছিল।

সামন্ত শ্রেণীর বিদ্রোহ
ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ

B. সামন্ত বিদ্রোহের বিপক্ষে যুক্তিঃ

আবার অন্যদিকে সুশোভন সরকার ও অন্যান্যরা মহাবিদ্রোহকে সামন্ততান্ত্রিক অভ্যুত্থান বলার বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন। তার মতে, আমরা ১৮৫৭ বিদ্রোহকে ‘জাতীয় সংগ্রাম’ বলতে পারি। কিন্তু কখনোই একে সামন্ততান্ত্রিক অভ্যুত্থান বলতে পারি না।

সামন্ত শ্রেণীর বিভক্তিঃ

মহাবিদ্রোহের সময় সামন্ত ব্যবস্থার প্রধান স্তম্ভ ও পৃষ্ঠপোষক রাজন্য বর্গের অনেকেই এই বিদ্রোহে যোগ দেননি। অনেক দেশীয় রাজা এই বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিল। এমনকি এদের কেউ কেউ বিদ্রোহ দমনে ইংরেজদের নানাভাবে সাহায্য করেছিল। সুতরাং ১৮৫৭র বিদ্রোহে যদি বিন্দু মাত্র সামন্ততান্ত্রিক অভ্যুত্থানের লক্ষণ থাকতো তাহলে তারা কখনোই এই বিদ্রোহের দ্বিচারিতা করত না।

সাধারণ কৃষক ও সৈনিকদের অংশগ্রহণঃ

ড.সরকারের মতে, মহাবিদ্রোহের স্বতঃস্ফূর্ত ও অসংগঠিত রূপ থেকে এটি প্রমাণিত হয় না যে এই বিদ্রোহ ছিল সামন্তদের পরিচালিত বিদ্রোহ। বিদ্রোহে সামন্ত শ্রেণীর পাশাপাশি সাধারণ কৃষক ও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ভারতীয় সৈন্যরা বিশাল সংখ্যায় অংশগ্রহণ করেছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটানো, যা সামন্ত শ্রেণীর স্বার্থ ছাড়িয়ে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে পরিণত হয়।

উপসংহারঃ

১৮৫৭-এর বিদ্রোহ শুধুমাত্র সামন্ত শ্রেণীর বিদ্রোহ নয়; এটি ছিল বহুমুখী এক গণআন্দোলন। যেখানে সামন্ত শ্রেণী, কৃষক, সৈন্য, এবং সাধারণ মানুষ একত্রে অংশগ্রহণ করেছিল। যদিও সামন্ত শ্রেণীর ভূমিকা এতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তবে এটি বৃহত্তর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে চিহ্নিত। তাই ঐতিহাসিক Christopher Bayly যথার্থই বলেছেন-‘The Indian Rebellion of 1857 was not movement ……it was many.’

ঔপনিবেশিক অরণ্য আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য কি ছিল?: প্রশ্নের উত্তরটি দেখতে Click করুন এখানে।

তথ্যসূত্রঃ

এই ব্লগের কাজ করতে Wikipedia এর সাহায্য নেয়া হয়েছে।

মহাবিদ্রোহ সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন-উত্তরঃ

প্রশ্ন: ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের প্রধান কারণ কী?

উত্তর: বিদ্রোহের প্রধান কারণ ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সামরিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, এবং সামাজিক অসন্তোষ। ইংরেজদের ভূমি অধিগ্রহণ, ধর্মীয় সংবেদনশীলতায় আঘাত এবং সেনাবাহিনীর সিপাহিদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ এর মূল কারণ।

প্রশ্ন: এই বিদ্রোহকে সামন্ত শ্রেণীর বিদ্রোহ বলা হয় কেন?

উত্তর: এই বিদ্রোহে সামন্ত শ্রেণীর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। তারা ব্রিটিশ শাসনের কারণে তাদের জমি, ক্ষমতা, এবং প্রভাব হারিয়েছিল। অনেক সামন্ত নেতা, যেমন হাজরত মহল, নানাসাহেব এবং রানি লক্ষ্মীবাই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন।

প্রশ্ন: এই বিদ্রোহে সামন্ত শ্রেণীর কি সবসময় সক্রিয় ভূমিকা ছিল?

উত্তর: না, সব সামন্ত শ্রেণী বিদ্রোহে অংশ নেয়নি। অনেক দেশীয় রাজা ইংরেজদের পক্ষ নিয়েছিলেন এবং বিদ্রোহ দমনে সাহায্য করেছিলেন।

প্রশ্ন: ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে সাধারণ কৃষকদের ভূমিকা কী ছিল?

উত্তর: সাধারণ কৃষকরা ব্রিটিশ শাসনের কর বৃদ্ধি, জমি কেড়ে নেওয়া, এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল। তারা সামন্ত নেতাদের সমর্থন দিয়েছিল, যা বিদ্রোহের শক্তি বৃদ্ধি করেছিল।

প্রশ্ন: এই বিদ্রোহে সিপাহিদের ভূমিকা কী ছিল?

উত্তর: ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ভারতীয় সিপাহিরা বিদ্রোহের মুখ্য অংশীদার ছিল। তারা তাদের ধর্মীয় এবং জাতিগত অনুভূতিতে আঘাত পাওয়ার কারণে বিদ্রোহ করেছিল।

প্রশ্ন: এই বিদ্রোহের প্রধান নেতারা কারা ছিলেন?

উত্তর: প্রধান নেতারা ছিলেন নানাসাহেব, রানি লক্ষ্মীবাই, হাজরত মহল, তাতিয়া টোপে এবং কুঁয়ার সিং।

প্রশ্ন: ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের উদ্দেশ্য কী ছিল?

উত্তর: বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসন উৎখাত করা এবং পূর্ববর্তী ক্ষমতাধারীদের, বিশেষত মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের অধীনে শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।

প্রশ্ন: এই বিদ্রোহ কি শুধুমাত্র সামন্ততান্ত্রিক আন্দোলন ছিল?

উত্তর: না, এটি একটি বহুমুখী বিদ্রোহ ছিল। সামন্ত শ্রেণী নেতৃত্ব দিলেও কৃষক, সিপাহি এবং সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এটিকে একটি বৃহৎ গণআন্দোলনে পরিণত করেছিল।

প্রশ্ন: এই বিদ্রোহ কি ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের সূচনা বলে বিবেচিত হয়?

উত্তর: হ্যাঁ, অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ ভারতীয় জাতীয় আন্দোলনের সূচনা। এটি ভবিষ্যৎ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পথ দেখিয়েছিল।

প্রশ্ন: ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের ফলাফল কী ছিল?

উত্তর: বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও, এটি ব্রিটিশ শাসনে বড় পরিবর্তন আনে। কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে এবং ব্রিটিশ সরকার সরাসরি ভারতের শাসনভার গ্রহণ করে।

আরো পড়ুনঃ

Sharing Is Caring:

Leave a Comment