ধর্ম তথা সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যে ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামমোহন রায় ‘ব্রাহ্মসভা‘ প্রতিষ্ঠা করেন। যা পরবর্তীকালে ব্রাহ্মসমাজ (১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে) হিসেবে প্রসিদ্ধ লাভ করে।
রামমোহন রায় বিশ্বাস করতেন সকল ধর্মের মধ্যে এক অভিন্ন সত্য রয়েছে এবং তার প্রচার এবং প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। এই জন্য তিনি তার কয়েকজন বিশিষ্ট বন্ধুদের নিয়ে এক সার্বজনীন উপাসনার মাধ্যমে কলকাতায় ‘ব্রাহ্মসভা’ অর্থাৎ ঈশ্বরের সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। তাদের উপাস্য ছিল ‘নিরাকার ব্রহ্ম‘, তাই থেকেই নিজেদের ধর্মের নাম রাখেন ব্রাহ্ম। ব্রাহ্মসমাজ (ব্রাহ্মসভা) এর মূল উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন কুসংস্কার, মূর্তিপূজা এবং আচার অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা এবং এর পরিবর্তে এক সৎ ও নিখুত আধ্যাত্মিকতার প্রচার করা।
বাংলায় সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজের ভূমিকা
ভূমিকাঃ
উনিশ শতকে বাংলার সমাজ সংস্কার আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজ এক অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছিল। সেই সময় সমাজে প্রচলিত ছিল নানা কুসংস্কার, ধর্মীয় গোড়ামী, নারী অধিকারহীনতা, বাল্যবিবাহ বহুবিবাহের মতো নানা অনাচার। এই অনাচার দূর করে মানুষের মধ্যে আধুনিক ও যুক্তিবাদী মানসিকতার বিকাশ ঘটাতে এগিয়ে এসেছিল ব্রাহ্মসমাজ।
কুসংস্কারের বিরোধিতাঃ
বাংলার রক্ষণশীল ও কুসংস্কারচ্ছন্ন সমাজে প্রচলিত বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, অস্পৃশ্যতা প্রভৃতির বিরুদ্ধে ব্রাহ্ম সমাজের সদস্যরা প্রতিবাদ জানিয়েছিল। তারা প্রচলিত এই প্রথাগুলির অসারতা জনসমক্ষে তুলে ধরেছিলেন এবং জনগণকে সচেতন করেছিলেন।
ধর্মীয় সংস্কারঃ
ব্রাহ্মসমাজের মূল দর্শন ছিল একেশ্বরবাদ। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কেশব চন্দ্র সেন প্রমুখ ব্রাহ্ম নেতারা যুক্তিবাদী ও উদার ধর্মীয় আদর্শ প্রচার করেন, যা ধর্মীয় গোড়ামী ও সামাজিক অসঙ্গতি দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
জাতিভেদ প্রথা ও সামাজিক সমতা:
সমাজে প্রচলিত জাতিভেদ প্রথার অবসান ঘটিয়ে সামাজিক সমতা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা করেছিল ব্রাহ্মসমাজ। এর ফলে সমাজে বিদ্যমান সামাজিক বৈষম্য দূর হয়ে ভাতৃত্ববোধ গড়ে উঠেছিল।
নারী কল্যাণঃ
ভারতীয় নারীদের মধ্যে পর্দা প্রথার বিলুপ্তি, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধকরণ, নারী স্বাধীনতা, শিক্ষার প্রসার প্রভৃতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করে ব্রাহ্মসমাজ নারী কল্যাণে সচেষ্ট হয়েছিল।
তিন আইনঃ
১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার ‘তিন আইন‘ পাশ করেছিল। এই আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য ছিল-বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করা এবং বিধবা বিবাহ ও অশবর্ণ বিভাগ আইনসিদ্ধ করা
জাতীয় সংহতির প্রতিষ্ঠাঃ
উদার পন্থী ধর্মীয় আদর্শ, জাতীয়তাবাদী আদর্শ তথা ব্যক্তি স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ঐক্য ইত্যাদি প্রচারের মাধ্যমে ব্রাহ্মসমাজ জনগণের মধ্যে জাতীয় সংহতির বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল। ড. এ.আর.দেশাই বলেছেন যে, ‘ব্রাহ্মসমাজ ছিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ’।
সমাজসেবা ও জনহিতকর কাজঃ
ব্রাহ্ম সমাজের সদস্যগণ সমাজসেবা ও জনহিতকর কাজের মাধ্যমে সাধারণ দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশা লাঘবের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কেশবচন্দ্র সেন ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ‘সঙ্গত সভা‘ প্রতিষ্ঠা করে নিপীড়িত মানুষদের জন্য জনসেবার আদর্শ গ্রহণ করেছিলেন
উপসংহারঃ
মূলত ব্রাহ্ম সমাজের আন্দোলনই সামাজিক কুসংস্কারের মূলে আঘাত এনেছিল। যার ফলে জনকল্যাণকামী সমাজ এবং জাতীয় সংহতি গড়ে ওঠে। ভারতের সনাতন ভাবধারার সঙ্গে পাশ্চাত্যের ভাবধারা ও খ্রিস্ট ধর্মের সমন্বয়ে সাধিত হয়।
হুতোম প্যাঁচার নকশা গ্রন্থে-উনিশ শতকের বাংলার সমাজ চিত্র; উত্তরটি দেখতে Click করুন এখানে ।
তথ্যসূত্রঃ
এই ব্লগের কাজ করতে Wikipedia এর সাহায্য নেয়া হয়েছে।
ব্রাহ্মসমাজ ও বাংলার সমাজ সংস্কার সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
প্রশ্ন: ব্রহ্মসমাজ কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল?
উত্তর: ১৮২৮ সালে রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন, যা ১৮৩০ সালে ব্রহ্মসমাজ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
প্রশ্ন: ব্রহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য কী ছিল?
উত্তর: সমাজ থেকে মূর্তিপূজা ও ধর্মীয় কুসংস্কার দূর করে সার্বজনীন উপাসনার মাধ্যমে একেশ্বরবাদের প্রচার করা ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।
প্রশ্ন: ব্রহ্মসমাজের উপাস্য কে ছিলেন?
উত্তর:ব্রহ্মসমাজের উপাস্য ছিলেন ‘নিরাকার ব্রহ্ম’।
প্রশ্ন: ব্রহ্মসমাজ কোন কোন সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ছিল?
উত্তর: ব্রহ্মসমাজ বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, জাতিভেদ প্রথা এবং নারী অধিকারহীনতার মতো কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কাজ করেছিল।
প্রশ্ন: ব্রহ্মসমাজ নারী কল্যাণে কী কী ভূমিকা পালন করেছে?
উত্তর: ব্রহ্মসমাজ বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, জাতিভেদ প্রথা, এবং নারী অধিকারহীনতার মতো কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কাজ করেছিল।
প্রশ্ন: তিন আইন কী ছিল?
উত্তর: ব্রিটিশ সরকার ১৮৭২ সালে তিন আইন পাশ করে, যা বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ নিষিদ্ধকরণ এবং বিধবা বিবাহ ও অশবর্ণ বিবাহ আইনসিদ্ধ করার জন্য ছিল।
প্রশ্ন: জাতীয় সংহতি প্রচারের জন্য ব্রহ্মসমাজের কী ভূমিকা ছিল?
উত্তর: ব্রহ্মসমাজ উদার পন্থী ও জাতীয়তাবাদী আদর্শের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠার প্রচার করেছিল।
প্রশ্ন: ব্রহ্মসমাজের একজন প্রভাবশালী নেতা কেশবচন্দ্র সেন কী উদ্যোগ নিয়েছিলেন
উত্তর: কেশবচন্দ্র সেন ১৮৬০ সালে ‘সঙ্গত সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা সমাজসেবা এবং জনহিতকর কাজের জন্য নিপীড়িত মানুষদের সহায়তা করে।
প্রশ্ন: ড. এ.আর. দেশাই ব্রাহ্মসমাজ সম্পর্কে কী বলেছেন?
উত্তর: তিনি বলেছেন, ‘ব্রাহ্মসমাজ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ’।