ইতিহাস, দশম শ্রেণী

বিংশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা

Admin

No Comments

ভারতের উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা শুধুমাত্র স্বাধীনতার জন্যই লড়াই করেননি, বরং একটি সমাজতান্ত্রিক ও সমানতাবাদী ভারত গড়ার স্বপ্নও দেখেছিলেন।

উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করার মাধ্যমে বামপন্থীরা জাতীয় আন্দোলনে নতুন দিশা প্রদান করেছিল। তাদের আন্দোলন বৈপ্লবিক চেতনা, শ্রমিক-কৃষকদের অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হওয়া এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগঠিত সংগ্রামে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল।

Table of Contents

বিংশ শতকের ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা আলোচনা করঃ

ভূমিকাঃ

প্রখ্যাত বাঙালি বিপ্লবী, রাজনৈতিক নেতা মানবেন্দ্রনাথ রায়ের হাত ধরে তাসখন্দে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে কানপুরে প্রথম সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট সম্মেলন হয় এবং এখানে সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ারের সভাপতিত্বে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর থেকেই ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থী রাজনীতির দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকে।

শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করাঃ

বামপন্থীরা ১৯২০ দশকে শ্রমিকদের সংগঠন করতে ‘অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস'(AITUC) গড়ে তোলে। বাংলায় ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট নেতা মোজাফফর আহমেদ, হেমন্ত কুমার সরকার প্রমুখের নেতৃত্বে কৃষক ও শ্রমিকদের সংগঠিত করে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ‘ওয়ার্কস এন্ড প্রেজেন্ট পার্টি’ গঠিত হয়। এর অনুকরণে বোম্বাই, পাঞ্জাব ও যুক্তপ্রদেশে অনুরূপ পার্টি গড়ে ওঠে। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ওয়ার্কস অ্যান্ড প্রেজেন্ট পার্টি’।

কৃষক আন্দোলনে নেতৃত্বঃ

ভারতীয় কৃষক সভা (All India Kisan Sabha) ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বামপন্থীদের নেতৃত্বে। জমিদারি ব্যবস্থার বিলোপ এবং ভূমি সংস্কারের দাবি তারা জোরালোভাবে তুলে ধরে। তেলেঙ্গানা বিদ্রোহ (১৯৪৬-১৯৫১) ছিল বামপন্থীদের কৃষক আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ।

বিপ্লবী কার্যকলাপঃ

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে সাইমন কমিশন ভারতে এলে বামপন্থীরা কংগ্রেসের সাথে বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশ নেয়। তারা কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে উপস্থিত থেকে ক্রমাগতপূর্ণ স্বাধীনতা দাবি তোলে। যা ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের লাহোর অধিবেশনে পূর্ণতা পায়। ‘হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন‘ (HSRA)-এর মতো সংগঠন সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসন উৎখাত করার চেষ্টা চালায়। ভগৎ সিং, সূর্য সেন, এবং চট্টগ্রামের যুববিদ্রোহীরা এই ধারার প্রতিনিধিত্ব করেন।

ভারতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা
এম এন রায়

আইন অমান্য আন্দোলনঃ

ঔপনিবেশিক সরকার বামপন্থীদের আন্দোলন দমন করার জন্য ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ৩৩ জন কমিউনিস্ট নেতাকে গ্রেফতার ‘মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা‘ করে শুরু করে। তবুও আইন অমান্য আন্দোলনের সময় বোম্বাই রেলওয়ে মেন্স ইউনিয়নের সদস্যরা লাল পতাকা নিয়ে ধর্মঘট করে।, সোলপুরে বস্ত্র শিল্প শ্রমিকরা ধর্মঘট করে এবং সমান্তরাল সরকার গড়ে তোলে। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্টদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

কংগ্রেস সোসালিস্ট পার্টিঃ

কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হওয়ার পর তারা জাতীয় কংগ্রেসের সাথে যুক্ত হয়ে আচার্য নরেন্দ্র দেব ও জয়প্রকাশ নারায়নের উদ্যোগে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ‘কংগ্রেস সোসালিস্ট পার্টি’ বা ‘কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল‘ প্রতিষ্ঠা করে। এই পার্টি জমিদার ও বিগার কথার উচ্ছেদ, কৃষিঋণ মুকুব, খাজনা হাঁ প্রভৃত দাবি জানায়।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনে ভূমিকাঃ

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় বামপন্থীরা আন্দোলনকে আরও তীব্রতর করতে শ্রমিক ও কৃষকদের সমর্থন জোগাড় করে। যদিও কিছু বামপন্থী দল এই সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের কারণে ব্রিটিশদের সাথে সরাসরি বিরোধ করেনি, তবুও স্থানীয় স্তরে তাদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল।

উপসংহারঃ

বিংশ শতকের উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীরা একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও আদর্শগত শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বহু বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও কমিউনিস্টরা শ্রেণী সংগ্রামের চরিত্র বজায় রাখে। বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের কোন কোন কার্যক্রম সমালোচিত হয়। কিন্তু তাদের কার্যকলাপ যে জাতীয়তাবাদী ছিল এই কথা স্বীকার করতেই হয়।

মাধ্যমিক বাংলা সাজেশন 2025 দেখতে Click করুন এখানে।

তথ্যসূত্রঃ

এই ব্লগের কাজ করতে Wikipedia সাহায্য নেয়া হয়েছে।

উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তরঃ

প্রশ্ন: ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি কবে এবং কোথায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল?

উত্তর: ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের নেতৃত্বে তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

প্রশ্ন: ‘অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’ (AITUC) কেন গঠিত হয়েছিল?

উত্তর: শ্রমিকদের সংগঠন করার উদ্দেশ্যে ১৯২০-এর দশকে বামপন্থীরা ‘অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস’ (AITUC) গড়ে তোলে।

প্রশ্ন: বাংলায় ‘ওয়ার্কস এন্ড প্রেজেন্ট পার্টি’ কারা গঠন করেন?

উত্তর: বাংলায় ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট নেতা মোজাফফর আহমেদ, হেমন্ত কুমার সরকার প্রমুখের নেতৃত্বে কৃষক ও শ্রমিকদের সংগঠিত করে ‘ওয়ার্কস এন্ড প্রেজেন্ট পার্টি’ গঠিত হয়।

প্রশ্ন: ‘ভারতীয় কৃষক সভা’ (All India Kisan Sabha) কখন এবং কাদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল?

উত্তর: ‘ভারতীয় কৃষক সভা’ (All India Kisan Sabha) ১৯৩৬ সালে বামপন্থীদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

প্রশ্ন: তেলেঙ্গানা বিদ্রোহের মূল দাবি কি ছিল?

উত্তর: তেলেঙ্গানা বিদ্রোহের মূল দাবি ছিল জমিদারি ব্যবস্থার বিলোপ এবং ভূমি সংস্কার।

প্রশ্ন: ‘মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা’ কী ছিল?

উত্তর: ঔপনিবেশিক সরকার বামপন্থীদের আন্দোলন দমন করার জন্য ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ৩৩ জন কমিউনিস্ট নেতাকে গ্রেফতার করে এই মামলা শুরু করে।

প্রশ্ন: কংগ্রেস সোসালিস্ট পার্টি কীভাবে গঠিত হয়েছিল?

উত্তর: ১৯৩৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণার পর আচার্য নরেন্দ্র দেব ও জয়প্রকাশ নারায়নের নেতৃত্বে ‘কংগ্রেস সোসালিস্ট পার্টি’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি জমিদারি উচ্ছেদ এবং কৃষকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছিল।

প্রশ্ন: সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে বামপন্থীরা কী ভূমিকা পালন করেছিল?

উত্তর: ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশনের আগমনের সময় বামপন্থীরা কংগ্রেসের সঙ্গে বিক্ষোভে অংশ নেয়। তারা পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানায় এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে শক্তিশালী করে।

প্রশ্ন: ভারত ছাড়ো আন্দোলনে বামপন্থীদের ভূমিকা কী ছিল?

উত্তর: ভারত ছাড়ো আন্দোলনে বামপন্থীরা শ্রমিক ও কৃষকদের সংগঠিত করে আন্দোলনকে তীব্রতর করে তোলে। স্থানীয় স্তরে তাদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল।

প্রশ্ন: বামপন্থীদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য কী ছিল?

উত্তর: শুধুমাত্র স্বাধীনতা নয়, একটি সমাজতান্ত্রিক ও সমানতাবাদী ভারত গড়া ছিল তাদের মূল লক্ষ্য।

আরো পড়ুনঃ

Sharing Is Caring:

Leave a Comment