বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন (১৯০৫-১৯১১) ছিল ব্রিটিশ সরকারের বাংলাকে দুই ভাগে বিভক্ত করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এক ঐতিহাসিক গণআন্দোলন।
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৯ শে জুলাই লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন এবং ১৬ই অক্টোবর এটি কার্যকরী করেন। এর প্রতিবাদে সমগ্র বাংলা জুড়ে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের সূচনা হয়। এই আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণীর সক্রিয় ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। শ্রমিকদের একত্রিত ও সংগঠিত আন্দোলন কেবল ব্রিটিশ প্রশাসনের প্রতি প্রতিবাদই জোরদার করেনি, বরং জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় শ্রমিক শ্রেণীর ভূমিকা কিরূপ ছিল
ভূমিকাঃ
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণীর অংশগ্রহণ এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। তারা বিভিন্ন বয়কট, স্বদেশী আন্দোলন এবং প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে। তাদের একত্রিত প্রতিবাদের মাধ্যমে আন্দোলনের ভিত্তি শক্তিশালী হয়েছিল। শ্রমিক শ্রেণীর অংশগ্রহণ আন্দোলনকে গণমানুষের সংগ্রামে রূপান্তরিত করে।
শ্রমিকদের বিক্ষোভঃ
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও জাতিগত অপমান, ভূমি রাজস্ব বৃদ্ধি, স্থানীয় শিল্পের বিপর্যয় প্রভৃতি কারণে শ্রমিকরা বিক্ষোভ শুরু করে। সেই সঙ্গে তারা কাজের সময়সীমা হ্রাস, মজুরি বৃদ্ধি এবং অতিরিক্ত কাজের জন্য মজুরী বেশি দেওয়ার দাবি জানায়।
বঙ্গভঙ্গ কার্যকরের দিন শ্রমিকদের প্রতিবাদঃ
বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার দিন, ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর শ্রমিকরা ধর্মঘট ও বিক্ষোভে অংশ নেন। সরকারি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় ঐদিন সমস্ত দপ্তরে তালা ঝুলে ছিল। কলকাতার রাস্তায় যানবাহনের পরিবর্তে মিছিলে পরিপূর্ণ ছিল।
মুদ্রণ কর্মীদের ধর্মঘটঃ
কলকাতায় সরকারি ছাপাখানার কর্মীরা ধর্মঘট শুরু করে বি.জি.প্রেস, আই. জি.প্রেসে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বেসরকারি ছাপাখানা শ্রমিকরা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী লিফলেট ও পত্রিকা ছাপিয়ে আন্দোলনের প্রচার করেছিলেন। এই প্রচার শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে দিতে সহায়ক হয়েছিল।
কুলি ও মেথরদের ধর্মঘটঃ
রাস্তাঘাট পরিষ্কারের কাজে নিযুক্ত কুলি ও মেথররা আন্দোলনে অংশ নিয়ে ধর্মঘট ঘোষণা করেন। তারা পরিষেবা বন্ধ রেখে ব্রিটিশ প্রশাসনের প্রতি তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সুমিত সরকার তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, এইসব ধর্মঘটের সমর্থনে কলকাতার রাস্তায় মানুষের মিছিল বেরিয়েছিল। ধর্মঘটীতে সমর্থনে মানুষ চাঁদা দিয়েছি, সরবরাহ করেছিল খাদ্য।
রেল ও ট্রাম শ্রমিকদের ধর্মঘটঃ
রেল ও ট্রাম শ্রমিকরা আন্দোলনের সমর্থনে পরিবহন বন্ধ করে দেন। এর ফলে শহরের দৈনন্দিন কার্যকলাপ ব্যাহত হয় এবং ব্রিটিশ প্রশাসনের কার্যক্রমে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। চিত্তরঞ্জন দাস, বিপিনচন্দ্র পাল, লিয়াকত হোসেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ধর্মঘটীদের পাশে দাঁড়ান।
চটকল ও মিল শ্রমিকদের আন্দোলনঃ
বাংলায় ৩৭ টি চটপটলের মধ্যে কমপক্ষে ১৮ টি চটকল শ্রমিক ধর্মঘট দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এগুলির মধ্যে হাওড়ায় বাউরিয়া ফোর্ড গ্লাস্টার মিল, বজবজের ক্লাইভ জুট মিল ছিল অন্যতম। এছাড়া অশ্বিনীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে চটকল শ্রমিকদের নিয়ে বজ বজে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইন্ডিয়ান মিল হ্যান্ড ইউনিয়ন’।
বন্দরের ধর্মঘটঃ
কলকাতা বন্দরের শ্রমিকরা বিদেশি জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে ব্রিটিশ পণ্যের বর্জন কার্যক্রমে অংশ নেন। এদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এ.সি ব্যানার্জি ও প্রেমতোষ বোস।
বাংলার বাইরের শ্রমিকদের আন্দোলনঃ
কলকাতার বাইরের অঞ্চল, যেমন আসাম চা বাগান, ধানবাদ কয়লাখনি, এবং চট্টগ্রামের বন্দর শ্রমিকরাও এই আন্দোলনে অংশ নেন। তারা ধর্মঘট ও প্রতিবাদের মাধ্যমে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
উপসংহারঃ
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণীর ভূমিকা ছিল অসামান্য। তাদের ঐক্য, সংগঠন, এবং বলিষ্ঠ অংশগ্রহণ আন্দোলনের গতিকে ত্বরান্বিত করে। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করলে বাংলা শ্রমিক আন্দোলন তার গতি হারায়। তবে এই আন্দোলন পরবর্তীকালের শ্রমিক আন্দোলনগুলোকে প্রভাবিত করেছিল।
বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার বিকাশে ডা.মহেন্দ্রলাল সরকারের অবদানঃ সম্পূর্ণ উত্তরটি দেখতে Click করুন এখানে ।
তথ্যসূত্রঃ
এই ব্লগের কাজ করতে Wikiedia এর সাহায্য নেয়া হয়েছে।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় শ্রমিক শ্রেণীর ভূমিকা থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তরঃ
প্রশ্ন: বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন কী এবং এটি কবে অনুষ্ঠিত হয়?
প্রশ্ন: বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন ১৯০৫-১৯১১ সালের একটি ঐতিহাসিক গণআন্দোলন, যা ব্রিটিশ সরকারের বাংলাকে দুই ভাগে বিভক্ত করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। এটি ১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর কার্যকর করা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে শুরু হয়।
প্রশ্ন: শ্রমিক শ্রেণী কেন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল?
প্রশ্ন: শ্রমিক শ্রেণী দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, স্থানীয় শিল্পের বিপর্যয়, ও ব্রিটিশ শাসনের অন্যায় নীতির প্রতিবাদে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল। তাদের অংশগ্রহণে জাতীয়তাবাদী চেতনা আরও প্রসার লাভ করে।
প্রশ্ন: এই আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণীর অংশগ্রহণ কেন গুরুত্বপূর্ণ ছিল?
প্রশ্ন: শ্রমিক শ্রেণীর অংশগ্রহণ আন্দোলনকে গণমানুষের সংগ্রামে রূপান্তরিত করে। তাদের একত্রিত প্রতিবাদের মাধ্যমে আন্দোলনের ভিত্তি শক্তিশালী হয়েছিল। শ্রমিক শ্রেণীর অংশগ্রহণ আন্দোলনকে গণমানুষের সংগ্রামে রূপান্তরিত করে।
প্রশ্ন: এই আন্দোলনে শ্রমিকরা কী কী ধরনের প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করেছিল?
প্রশ্ন: শ্রমিকরা বিভিন্ন বয়কট, স্বদেশী আন্দোলন এবং প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছিল। তারা ধর্মঘট, মিছিল, বিক্ষোভ, পণ্য খালাস বন্ধ করে প্রতিবাদ জানিয়েছিল।
প্রশ্ন: বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার দিন শ্রমিকরা কী করেছিল?
প্রশ্ন: বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার দিন, ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর, শ্রমিকরা ধর্মঘট ও বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিল। সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঐদিন সমস্ত দপ্তরে তালা ঝুলে ছিল এবং কলকাতার রাস্তায় মিছিলে পরিপূর্ণ ছিল।
প্রশ্ন: শ্রমিকদের আন্দোলন আন্দোলনের গতিপথকে কীভাবে প্রভাবিত করেছিল?
প্রশ্ন: শ্রমিকদের ঐক্য, সংগঠন, এবং বলিষ্ঠ অংশগ্রহণ আন্দোলনের গতিকে ত্বরান্বিত করেছিল। তাদের প্রতিবাদ ব্রিটিশ প্রশাসনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
প্রশ্ন: শ্রমিকদের আন্দোলন কীভাবে সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করেছিল?
প্রশ্ন: শ্রমিকদের আন্দোলন সাধারণ মানুষকে আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। শ্রমিকদের বলিদান এবং সংগ্রামের মনোভাব সাধারণ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
প্রশ্ন: শ্রমিকদের আন্দোলন কীভাবে ব্রিটিশ প্রশাসনকে প্রভাবিত করেছিল?
প্রশ্ন: শ্রমিকদের আন্দোলন ব্রিটিশ প্রশাসনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শ্রমিকদের আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ প্রশাসনের কার্যকলাপে ব্যাঘাত ঘটেছিল এবং তাদের শাসন ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছিল।
প্রশ্ন: বাংলার বাইরের শ্রমিকরা আন্দোলনে কী ভূমিকা পালন করেছিল?
প্রশ্ন: আসামের চা বাগান, ধানবাদ কয়লাখনি, ও চট্টগ্রামের বন্দর শ্রমিকরা ধর্মঘট ও প্রতিবাদ করে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।
প্রশ্ন: শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিবাদ কীভাবে আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছিল?
প্রশ্ন: শ্রমিকদের একত্রিত প্রতিবাদ ও ধর্মঘট আন্দোলনের ভিত্তিকে শক্তিশালী করে এবং ব্রিটিশ প্রশাসনের উপর চাপ সৃষ্টি করে।