বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র সমাজের চরম উৎসাহ ও দেশমাতার প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি দেশবাসীকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছিল।
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৯ শে জুলাই লর্ড কার্জন সরকারিভাবে বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। ১৬ই অক্টোবর এই ঘোষণা কার্যকর হয়। এর প্রতিবাদে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী যে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে ওঠে তাতে বাংলা তথা ভারতের ছাত্র সমাজ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। ছাত্রদের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন- সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, অশ্বিনী কুমার দত্ত, অম্বিকা চরণ মজুমদার, আনন্দ চন্দ্র রায়, উমেশচন্দ্র গুপ্ত, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ। এই আন্দোলনে ছাত্রদের উৎসাহ দেখে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছাত্র সমাজকে স্বদেশী আন্দোলনের স্বনিয়োজিত প্রচারক বলে অভিহিত করেছেন।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা বিশ্লেষণ কর।
ভূমিকা:
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড কার্জনের নির্দেশে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হলে সমগ্র বাংলায় তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য। তারা কেবল আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেই থেমে থাকেনি, বরং একে গণআন্দোলনে রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল।
ছাত্র কমিটি গঠনঃ
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ৩১ শে জুলাই কলকাতার বিভিন্ন কলেজের ছাত্র প্রতিনিধিরা একত্রিত হয়ে ‘কেন্দ্রীয় ছাত্র কমিটি ‘ গঠন করে। এই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুসারে ছাত্রসমাজ প্রথম থেকেই বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসে। স্কুল, কলেজ, পাঠশালার ছাত্ররা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্লোগান তোলে এবং মিছিলে অংশ নেয়।
পিকেটিং ও বিদেশী দ্রব্য বর্জনঃ
ছাত্ররা বিদেশী দ্রব্য বর্জন করে। শুধু তাই নয় বিলিতি পণ্যের (ইংরেজি কাপড়, লবণ, চিনি, মদ, সিগারেট) দোকানের সামনে পিকেটিং শুরু করে। এমনকি তারা বিলেতি পণ্যে অগ্নিসংযোগ পর্যন্ত করে। তারা পথচলতি মানুষকে স্বদেশি বস্ত্র ব্যবহারে উৎসাহিত করে।
বিপ্লবী কর্মকাণ্ডঃ
অনেক ছাত্র পুলিশি নির্যাতন, গ্রেফতার, এমনকি বহিষ্কারের সম্মুখীন হয়েও আন্দোলনের পথ থেকে সরে যায়নি। কয়েকজন ছাত্র পরবর্তীতে বিভিন্ন বিপ্লবী সংগঠনে যুক্ত হন এবং সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেন। যেমন—অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর দল প্রভৃতি সংগঠনে। মেদিনীপুরের হ্যামিল্টন স্কুলের ছাত্র ক্ষুদিরাম বসু ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে গিয়ে ধরা পরলে ফাঁসি হয়।
বয়কট আন্দোলনঃ
বয়কট করছো শব্দের অর্থ ‘বর্জন’। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদী কৃষ্ণ কুমার মিত্র ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ৭ই আগস্ট বয়কটের ডাক দেন। এই ডাকে সাড়া দিয়ে ছাত্ররা কলেজ স্কোয়ার থেকে মিছিল করে পাঁচ হাজার ছাত্র টাউন হলের সভায় যোগ দেয়। ছাত্রদের এই অংশগ্রহণে আতঙ্কিত ব্রিটিশ সরকার নানা দমনমুলক নীতি গ্রহণ করে।
উপসংহার:
ছাত্র সমাজের সাহসিকতা, উদ্যম ও আত্মত্যাগ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনকে গণআন্দোলনের রূপ দিতে সহায়তা করেছিল। এই আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতীয় ছাত্র সমাজের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বীজ বপন হয় এবং ভবিষ্যতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা নির্ভীক সৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে নারী সমাজের ভূমিকা; সম্পূর্ণ উত্তর দেখতে Click করুন এখানে।
তথ্যসূত্র:
এই ব্লগের কাজ করতে Wikipedia এর সাহায্য নেওয়া হয়েছে।
FAQ
প্রশ্ন: বঙ্গভঙ্গ কবে ঘোষণা ও কার্যকর হয় ?
উত্তর: বঙ্গভঙ্গ ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে জুলাই ঘোষণা করা হয় এবং ১৬ই অক্টোবর কার্যকর হয়।
প্রশ্ন: বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের উৎসাহ কেমন ছিল ?
উত্তর: ছাত্র সমাজ এই আন্দোলনে চরম উৎসাহ ও দেশপ্রেম প্রদর্শন করে, যা সমগ্র জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছিল।
প্রশ্ন: ছাত্ররা কীভাবে আন্দোলনের সংগঠনে অংশগ্রহণ করে ?
উত্তর: ছাত্ররা ৩১ জুলাই ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে কেন্দ্রীয় ছাত্র কমিটি গঠন করে এবং বিভিন্ন মিছিল, সভা ও বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে।
প্রশ্ন: পিকেটিং বলতে কী বোঝায় এবং এতে ছাত্রদের ভূমিকা কী ছিল ?
উত্তর: পিকেটিং মানে দোকানের সামনে প্রতিবাদ করে পণ্য বিক্রি বন্ধ করা। ছাত্ররা বিলিতি দ্রব্যের দোকানে পিকেটিং করে ও বিদেশি পণ্যের বিরোধিতা করে।
প্রশ্ন: ছাত্ররা কী ধরনের দ্রব্য বর্জন করেছিল ?
উত্তর: ছাত্ররা ইংরেজি কাপড়, লবণ, চিনি, মদ, সিগারেট ইত্যাদি বিদেশি দ্রব্য বর্জন করেছিল।
প্রশ্ন: ছাত্রদের মধ্যে থেকে কোন বিপ্লবীরা উঠে এসেছিলেন ?
উত্তর: অনেকে পরবর্তীতে বিপ্লবী সংগঠনে যোগ দেন, যেমন ক্ষুদিরাম বসু, যিনি কিংসফোর্ড হত্যাচেষ্টায় অংশগ্রহণ করে ফাঁসিতে ঝুলেছিলেন।
প্রশ্ন: বয়কট আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা কী ছিল ?
উত্তর: ছাত্ররা হাজার হাজার সংখ্যায় মিছিলে অংশ নিয়ে টাউন হলের সভায় যোগ দেয় এবং বিদেশি পণ্যের বয়কটের পক্ষে প্রচার চালায়।
প্রশ্ন: বয়কট শব্দটি প্রথম কোথায় ও কবে ব্যবহার হয়েছিল ?
উত্তর: ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ই আগস্ট কৃষ্ণ কুমার মিত্র বয়কট শব্দটি ব্যবহার করেন।
প্রশ্ন: ছাত্রদের আন্দোলনের নেতৃত্বে কারা ছিলেন ?
উত্তর: সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, অশ্বিনী কুমার দত্ত, অম্বিকা চরণ মজুমদার, আনন্দ চন্দ্র রায়, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ ছাত্রদের নেতৃত্ব দেন।
প্রশ্ন: ছাত্রদের এই আন্দোলনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কী ছিল ?
উত্তর: এই আন্দোলনের মাধ্যমে ছাত্রদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বীজ রোপিত হয় এবং তারা ভবিষ্যতের স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।