স্বামী বিবেকানন্দ (১২ ই জানুয়ারি ১৮৬৩ – ৪ জুলাই ১৯০২) ছিলেন একজন হিন্দু সন্ন্যাসী, দার্শনিক, লেখক, সংগীতজ্ঞ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় অতীন্দ্রিয়বাদী রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রধান শিষ্য।
১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ ই জানুয়ারি কলকাতার সিমলাপাড়া দত্ত পরিবারে বিবেকানন্দের জন্ম হয়। তার পিতা ও মাতা ছিলেন বিশ্বনাথ দত্ত ও ভুবনেশ্বরী দেবী। শৈশবে তার নাম ছিল বীরেশ্বর বা বিলে, পরেনাম হয় নরেন্দ্রনাথ দত্ত। পরে ক্ষেত্রির মহারাজ অজিত সিংহ স্বামী বিবেকানন্দ নামটি গ্রহণ করার অনুরোধ করলে, ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের ৩১ শে মে আমেরিকার শিকাগো চলে যাবার সময় নামটি গ্রহণ করেছিলেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে হিন্দুধর্ম তথা ভারতীয় বেদান্ত ও যোগ দর্শনের প্রচারে তিনি অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন। ব্রিটিশ ভারতে হিন্দুদের পুনর্জাগরণ ও ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের ধারণাটি প্রবর্তন করেছিলেন। এইজন্য ঐতিহাসিক আর.জি. প্রধান তাকে ‘আধুনিক ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক‘ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই মহামানব কে স্মরণ রাখতে, শ্রদ্ধা জানাতে ১৯৮৪ সালে ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নেয় ১৯৮৫ সাল থেকে প্রতিবছর স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনটি জাতীয় যুব দিবস হিসেবে পালন করা হবে। সেই মোতাবেক প্রতিবছর ১২ই জানুয়ারি জাতীয় যুব দিবস পালন করা হয়।
স্বামী বিবেকানন্দের ধর্ম সংস্কারের আদর্শ
ভূমিকা:
উনিশ শতকের ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের ঋত্বিক স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন রামমোহন রায় প্রবর্তিত সংস্কার আন্দোলনে শেষ প্রতিনিধি। রামকৃষ্ণ যদি জীবন্ত বেদান্ত হন তবে স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন বেদান্তের ভাষ্যকর। রামকৃষ্ণের ভাবাদর্শ তার প্রধান শিষ্য বিবেকানন্দের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়েছ।
নব্য বেদান্তের প্রচারক:
‘বেদান্ত‘ সম্পর্কে বিবেকানন্দের নতুন উপলব্ধিই হলো ‘নব্য বেদান্ত‘ । তিনি প্রাচীন অদ্বৈত দর্শনের নিজস্ব ব্যাখ্যা দিয়ে এটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন। তার মতে, সার্বজনীন ধর্মের ভিত্তিভূমি তৈরি করেছে বেদান্ত। কুসংস্কার, অস্পৃশ্যতা, জাতিভেদ,ধনী–দরিদ্রের প্রভেদ দূর করে তিনি জাতিকে ঐক্য ও কর্মশক্তিতে উদ্দিপ্ত হওয়ার আহ্বান জানান। তার নব্য বেদান্তের অভিমুখ ছিল-জগতের কল্যাণে নিজের মোক্ষ লাভ।
বিবেকানন্দের দর্শন:
ভারতবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিবেকানন্দ বলেছিলেন,’ সদর্পে বল আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই‘। তিনি বলতেন,’ ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশজ্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারানসি। বল ভাই-ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ, ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ’। তিনি চেয়েছিলেন, যুব সমাজ আগুন ছড়িয়ে দেবে হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত। উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত। তার মূলমন্ত্র ছিল-‘ জীবে প্রেম করে যেইজন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’। বিবেকানন্দ বলতেন-‘ গীতা পাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলা ভালো‘।
বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের প্রচারক:
১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো ধর্ম সম্মেলনে তিনি হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেছিলেন। সেখানে তিনি তার বক্তৃতায় ভারতের সনাতন হিন্দু ধর্মের বিশ্বজনীন আদর্শ এবং বিশ্বজনীন মানব প্রেমের আদর্শ নব্য বেদান্তের আলোকে ব্যাখ্যা করে বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করেছিলেন। তার বক্তৃতার মাধ্যমেই তিনি পাশ্চাত্য সমাজে প্রথম হিন্দু ধর্ম প্রচার করেছিলেন।
মানুষ গড়ার ধর্ম:
বেদান্ত অর্থাৎ বেদের শেষ ভাগ-বেদের চরম লক্ষ্য। বিবেকানন্দের উদ্দেশ্য ছিল প্রাচ্য-পাশ্চাত্য, প্রাচীন ও আধুনিক ভারতীয় জীবন দর্শনের সমন্বয়ে এক নতুন ভারত গড়ে তোলা। তার ধর্ম ছিল-‘মানুষ তৈরি ধর্ম‘ বা ‘Man-making religion’ ।
উপসংহার:
মানবতাবাদী, জাতীয় চেতনায় অনুপ্রাণিত বিবেকানন্দ ধর্ম সংস্কারের মধ্যে দিয়ে সমাজসেবার অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। ভারতবাসীর মনে সঞ্চার করেছিলেন আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদা। দেশ ও জাতির পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য যে মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন বিবেকানন্দ তাই সরবরাহ করেছিলেন তার জীবন ও বাণীর মধ্যে দিয। পন্ডিত রোমাঁ রোঁলার ভাষায়- স্বামীজীর ভাবধরা সর্ব যুগেই প্রাসঙ্গিক।
উনিশ শতকে নারী শিক্ষা বিস্তারে রাধাকান্ত দেবের ভূমিকা: প্রশ্নের উত্তরটি দেখতে Click করুন এখানে ।
তথ্যসূত্র:
এই ব্লগের কাজ করতে Wikipedia সাহায্য নেয়া হয়েছে ।
বিবেকানন্দ ও তার ধর্ম সংস্কার সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন-উত্তর:
প্রশ্ন: ‘রামকৃষ্ণ মঠ’ ও ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ কে, কবে, কেন প্রতিষ্ঠা করেন?
উত্তর: ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১ মে কলকাতায় বিবেকানন্দ ধর্ম প্রচারের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘রামকৃষ্ণ মঠ’ এবং সামাজিক কাজের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন ‘রামকৃষ্ণ মিশন’।এটি ছিল শিক্ষামূলক, সাংস্কৃতিক, চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজের মধ্য দিয়ে জনগণকে সাহায্য করার এক সামাজিক-ধর্মীয় আন্দোলনের প্রারম্ভ।
প্রশ্ন: বিবেকানন্দ রচিত গ্রন্থগুলির নাম লেখ?
উত্তর: তার রচিত গ্রন্থ গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য-জ্ঞানযোগ, রাজযোগ, কর্মযোগ, শিকাগো বক্তৃতা, হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদান্ত, ভারতে বিবেকানন্দ, ভাববার কথা, বর্তমান ভারত, পরিব্রাজক, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, বীরবানি, মোদীয় আচার্যদেব ইত্যাদি ।
প্রশ্ন: বিবেকানন্দ রচিত দুটি গানের নাম লেখ?
উত্তর: তার রচিত দুটি বিখ্যাত গান হল- ‘খণ্ডন-ভব-বন্ধন’ ও ‘নাহি সূর্য নাহি জ্যোতি’।
প্রশ্ন: বিবেকানন্দ রচিত কয়েকটি কবিতার নাম লেখ?
উত্তর: তার রচিত কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা হল- ‘ নাচুক তাহাতে শ্যামা’,’৪ জুলাইয়ের প্রতি’,’ সন্ন্যাসীর গীতি’,’ সখার প্রতি’ ইত্যাদি।
প্রশ্ন: বিবেকানন্দের কয়েকজন শিষ্য ও শিষ্যার নাম লেখ ।
উত্তর: আইরিশ কন্যা ভগিনী নিবেদিতা ছিলেন বিবেকানন্দের অন্যতম শিষ্যা। এছাড়াও সদানন্দ, অভয়ারানন্দ, পরমানন্দ, অশোকানন্দ, বিরজানন্দ, পেরুমল প্রমুক তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
প্রশ্ন: বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত কয়েকজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের নাম লেখ?
উত্তর: স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে প্রভাবিত হয়েছিলেন-অরবিন্দ ঘোষ, সুভাষচন্দ্র বসু, বাঘাযতীন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বসু, বালগঙ্গাধর তিলক প্রমুখ।
প্রশ্ন: ‘নব্য বেদান্তের’ আদর্শ কে প্রচার করেছিলেন?
উত্তর: স্বামী বিবেকানন্দ।
প্রশ্ন: জাতীয় যুব দিবস কবে পালন করা হয়?
উত্তর: বিবেকানন্দের জন্মদিন ১২ই জানুয়ারি জাতীয় যুব দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
প্রশ্ন:’ মানুষ তৈরীর ধর্ম’ বা ‘Man-making religion’ এর কথা কে বলেছিলেন?
উত্তর: স্বামী বিবেকানন্দ
প্রশ্ন: ভারতে ‘বীর সন্ন্যাসী’ নামে কাকে অভিহিত করা হয়?
উত্তর: বিবেকানন্দকে।