ইতিহাস, দশম শ্রেণী

বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবা বিবাহ আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ

Admin

No Comments

বিধবা বিবাহ আন্দোলনের মূল রূপকার হলেন পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর । তার প্রচেষ্টায় তৎকালীন বড়লাট লর্ড ডালহৌসি বিধবা বিবাহ এর সমর্থনে আইনের খসড়া তৈরি করেন।

শেষ পর্যন্ত লর্ড ক্যানিং ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে জুলাই ১৫ নম্বর রেগুলেশন দ্বারা বিধবা বিবাহকে আইনসঙ্গত বলে ঘোষণা করেন।

Table of Contents

বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবা বিবাহ আন্দোলনঃ

ভূমিকাঃ

উনিশ শতাব্দীর ভারতে বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবা বিবাহ আন্দোলন এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সংস্কার হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সেই সময় সমাজে যে সমস্ত কু-প্রথা প্রচলিত ছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল বাল্যবিবাহ। আর বাল্যবিবাহের অবশ্যশাম্বি ফল হল বাল্য বিধবা। প্রাচীনকালে বিধবা বিবাহের প্রচলন থাকলেও পরবর্তীতে ধর্মীয় ও সামাজিক বিধি-নিষেধে বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ হয়। এই অন্যায় রীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন বিদ্যাসাগর।

বিধবাদের অবস্থাঃ

তৎকালীন সমাজে বিধবারা ছিলেন চরম অবহেলিত ও নিপীড়িত। তাদের পুনর্বিবাহ সমাজের চোখে নিষিদ্ধ ছিল। বিধবারা জীবন কাটাতেন এক ঘৃণার পরিবেশে। তাদের কোন অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা ছিল না।

জনমত গঠনঃ

১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর ‘তত্ত্ববোধিনী‘ পত্রিকাতে বিধবা বিবাহ বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশ করে জনমত গঠন করতে থাকেন। এজন্য তিনি ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব‘ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে, বিধবা বিবাহের সমর্থনে প্রচার করেন। এছাড়া ‘সর্বশুভকরি’ পত্রিকায় ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ নামক একটি প্রবন্ধ লেখেন। এখানে তিনি বিধবা বিবাহ প্রচলন এর পক্ষে তার বক্তব্য ও চিন্তাভাবনার কথা তুলে ধরেন ।

আইন প্রণয়নের উদ্যোগঃ

বিদ্যাসাগর এই প্রথা কে আইনসঙ্গত করার জন্য বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির স্বাক্ষর সম্বলিত একটি আবেদন পত্র ব্রিটিশ সরকারের কাছে জমা দেন। তার আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে তৎকালীন বড়লাট লর্ড ডালহৌসি বিধবা বিবাহের সামর্থনে আইনের খসড়া তৈরি করেন। শেষ পর্যন্ত লর্ড ক্যানিং ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের ২৬ শে জুলাই ১৫ নম্বর রেগুলেশন দ্বারা বিধবা বিবাহকে আইনসঙ্গত বলে ঘোষণা করেন।

বিধবা বিবাহের প্রচলনঃ

বিধবা বিবাহের আইন পাস হওয়ার পর ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর বিদ্যাসাগরের অনুরোধে প্রথম বিধবকে বিবাহ করেন সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। তিনি বর্ধমানের বিধবা কালীমতি দেবীকে বিবাহ করেছিলেন। এটিই ছিল বাংলার প্রথম বিধবা বিবাহ। এছাড়া বিদ্যাসাগর ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে নিজুপুত্র নারায়ণ চন্দ্রের সঙ্গে ভবসুন্দরী নামে এক বিধবার বিবাহ দিয়েছিলেন। জানা যায়, বিদ্যাসাগর ১৮৫৬-৬৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রায় ৬০ জন বিধবার বিবাহ দিয়েছিলেন।

বিরোধীদের জবাবঃ

বিধবা বিবাহ বিরোধীদের বিরুদ্ধাচারণের উত্তর দেয়ার জন্য বিদ্যাসাগর ‘অতি অল্প হইল‘ ও ‘আবার অতি অল্প হইল‘ নামে দুটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। তার আন্দোলনের ফলে বিধবা নারীরা মুক্তির স্বপ্ন দেখার সুযোগ পায়।

বিধবা বিবাহ আন্দোলন
বিদ্যাসাগর

বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবা বিবাহের সাফল্যঃ

বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবা বিবাহ আন্দোলন যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছিল-

নারী মুক্তিঃ

বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলনের ফলে বিধবা রমণীরা মুক্তির স্বপ্ন দেখার সুযোগ পায়। এর ফলে সমাজে নারীঘটিত ব্যভিচার ও অপরাধের মাত্রা বহুগুণ হ্রাস পায়।

বিধবা বিবাহের প্রসারঃ

বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। বোম্বাইয়ের প্রার্থনা সমাজ ও মহারাষ্ট্রে ডি কে কার্ভে-র চেষ্টায় বিধবা বিবাহের প্রসার ঘটেছিল। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন বিরসালিঙ্গম পানতুলু। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে ‘সোসাইটি ফোর সোশ্যাল রিফর্ম‘ গঠন করে তিনি তেলেগুভাসি অঞ্চলে বিধবা বিবাহ আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেন। এজন্য তাকে ‘দক্ষিণ ভারতের বিদ্যাসাগর‘ বলা হয়।

সমাজ সচেতনতা বৃদ্ধিঃ

বিধবা বিবাহ আন্দোলনের থেকে সমাজে সচেতনতা বোধের জাগরণ ঘটে। কালক্রমে সমাজে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের সংখ্যা হ্রাস পেলে বিধবাদের সংখ্যাও হ্রাস পেতে শুরু করে।

সুদূর প্রসারী প্রভাবঃ

রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের প্রবল বাধা থাকার সত্বেও বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবা বিবাহ আন্দোলন থেমে থাকেনি। এমনকি ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে বহু তরণ ব্রাহ্ম বিধবা বিবাহ করতে থাকেন। এইভাবেই বিধবা বিবাহ আন্দোলন ধীরে ধীরে সমাজে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে।

উপসংহারঃ

বিদ্যাসাগর নেতৃত্বে বিধবা বিবাহ আন্দোলন ছিল তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তার এই উদ্যোগের ফলে হিন্দু বিধবা নারীরা নতুন জীবনের সন্ধান পায়। এ প্রসঙ্গে বিনয় ঘোষ বলেন, ‘উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলনই প্রথম সর্বভারতীয় আন্দোলন’ ।

লর্ড মেকলেকে কি এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তক বলা যায়?: উত্তরটি দেখতে Click করুন এখানে

তথ্যসূত্রঃ

এই ব্লগের কাজ করতে Wikipedia এর সাহায্য নেওয়া হয়েছে ।

বিদ্যাসাগর ও বিধবা বিবাহ সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যঃ

প্রশ্ন: বিধবা বিবাহ আইন কে কবে পাস করেন?

উত্তর: গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিধবা বিবাহ আইন পাস করেন।

প্রশ্ন: প্রথম বিধবা বিবাহ কে করেন?

উত্তর: বিদ্যাসাগরের অনুরোধে ১৮৫৬ সালের ৭ ডিসেম্বর সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন প্রথম বিধবা বিবাহ করেন।

প্রশ্ন: বিধবা বিবাহ আন্দোলনের মূল রূপকার কে ছিলেন?

উত্তর: বিধবা বিবাহ আন্দোলনের মূল রূপকার ছিলেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

প্রশ্ন: প্রথম বিধবা বিবাহের নারী কে ছিলেন?

উত্তর: বর্ধমানের বিধবা কালীমতি দেবী।

প্রশ্ন: কত নম্বর আইন দ্বারা বিধবা বিবাহ আইন সংগত হয়?

উত্তর: ১৫ নম্বর রেগুলেশন আইন দ্বারা বিধবা বিবাহ আইন সংগত হয়।

প্রশ্ন: জনমত গঠনের জন্য বিদ্যাসাগর কী ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন?

উত্তর: বিদ্যাসাগর ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে, ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ নামে বই প্রকাশ করে এবং ‘সর্বশুভকরি’ পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখে বিধবা বিবাহের পক্ষে জনমত তৈরি করেছিলেন।

প্রশ্ন: উনিশ শতকের ভারতে বিধবা বিবাহ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা কেন অনুভূত হয়েছিল?

উত্তর: উনিশ শতকে বাল্যবিবাহের কারণে বহু নারী অল্প বয়সেই বিধবা হয়ে চরম অবহেলা ও নিপীড়নের শিকার হতেন। তাদের পুনর্বিবাহ সমাজে নিষিদ্ধ ছিল, যা নারী স্বাধীনতার পথে বাধা ছিল।

প্রশ্ন: বিধবা বিবাহ আন্দোলনের ফলে কী ধরনের সমাজ সচেতনতা বৃদ্ধি পায়?

উত্তর: এই আন্দোলনের ফলে নারী অধিকার, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের সমস্যা সম্পর্কে সমাজ সচেতন হয় এবং বিধবাদের প্রতি সমাজে সহানুভূতির মনোভাব জন্ম নেয়।

প্রশ্ন: অন্যান্য অঞ্চলে বিধবা বিবাহ আন্দোলনের প্রসারে কারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন?

উত্তর: বোম্বাইয়ে প্রার্থনা সমাজ এবং মহারাষ্ট্রে ডি কে কার্ভে, তেলেগু অঞ্চলে বিরসালিঙ্গম পানতুলু, যাকে দক্ষিণ ভারতের বিদ্যাসাগর বলা হয়, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

প্রশ্ন: উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে বিধবা বিবাহ আন্দোলনের তাৎপর্য কী?

উত্তর: বিনয় ঘোষের মতে, “উনিশ শতকের সমাজ সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাসে বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ আন্দোলনই প্রথম সর্বভারতীয় আন্দোলন,” যা হিন্দু বিধবাদের নতুন জীবনের সন্ধান দেয়।

আরো পড়ুন:

  • মাধ্যমিক ভূগোল সাজেশন- 2026
    মাধ্যমিক ভূগোল সাজেশনটি ২০২৬ সালের মাধ্যমিক ছাত্র-ছাত্রীদের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছে।বিগত বছরগুলিতে যে ধরনের প্রশ্ন এসেছে তার ওপর ভিত্তি করে। এই সাজেশনটি …

    Read More

  • মাধ্যমিক ইতিহাস সাজেশন-2026
    মাধ্যমিক ইতিহাস সাজেশনটি ২০২৬ সালের মাধ্যমিক ছাত্র-ছাত্রীদের কথা মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছে।বিগত বছরগুলিতে যে ধরনের প্রশ্ন এসেছে তার ওপর ভিত্তি করে। এই সাজেশনটি …

    Read More

  • সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স দলের ভূমিকা
    বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স দল বরিশালের তরুণ হেমচন্দ্র ঘোষের উদ্যোগে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে গঠিত হয়।এই দলের অন্যতম সদস্য ও সংগঠক ছিলেন সত্য গুপ্ত। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় পুলিনবিহারী …

    Read More

  • বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা বিশ্লেষণ কর
    বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র সমাজের চরম উৎসাহ ও দেশমাতার প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি দেশবাসীকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৯ শে জুলাই লর্ড কার্জন …

    Read More

  • কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল কেন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল
    ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেস সমাজতন্ত্রী দল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে থেকেই সমাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রচার ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। তারা সমাজে সাম্য, ন্যায় পক্ষপাতী ছিল। ভারতের …

    Read More

  • একা আন্দোলনের একটি সমালোচনামূলক বিবরণ দাও
    একা আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে মাদারি পাসির নেতৃত্ব ১৯২১-২২ খ্রি: উত্তরপ্রদেশের হরদই, বারাবাঁকি, সীতাপুর প্রভৃতি জেলায়। এই আন্দোলনের মূল কারণ ছিল-কৃষকদের নির্ধারিত …

    Read More

Sharing Is Caring:

Leave a Comment