ইতিহাস, দশম শ্রেণী

বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে নারী সমাজের অংশগ্রহণ ও সীমাবদ্ধতা

Admin

No Comments

বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে নারী সমাজ অংশগ্রহণ করেছিল। কারণ তারা বিদেশি দ্রব্য বর্জন করতে চেয়েছিল।

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী হলে সারা ভারতে নারীরা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। ভারতীয় নারীরা এই প্রথম জাতীয় আন্দোলন অংশগ্রহণ করে। অংশগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন-সরলা দেবী চৌধুরানী, লীলাবতী মিত্র, গিরিজাসুন্দরী দেবী, দুকরিবালা দেবী, সরোজিনী দেবী, ব্রহ্মময়ী সেন প্রমুখ।

Table of Contents

বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে নারী সমাজ কিভাবে অংশগ্রহণ করেছিল?

ভূমিকাঃ

বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন (১৯০৫-১৯১১) ছিল বাংলার সমাজ-রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই আন্দোলনে নারীসমাজ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে, যা ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের অংশগ্রহণের এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

অরন্ধন ও রাখি বন্ধন উৎসবঃ

১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ওই দিনটিকে অরন্ধন দিবস পালনের আহ্বান জানান। তার আহ্বানে বাংলার মা বনেরা ওই দিন ‘অরন্ধন দিবস’ পালন করে। এই প্রেক্ষাপটে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী রচনা করেন ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা‘। আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রস্তাবক্রমে ঐদিন পালিত হয় ‘রাখিবন্ধন’ উৎসব। তাতে মেয়েরা সক্রিয় ভাবে অংশ নেয়। শহর গ্রাম-গঞ্জের মন্দিরে, রাস্তায়, স্নানের ঘাটে সর্বত্র এই উৎসব ছড়িয়ে পড়ে।

স্বদেশী আন্দোলনে অংশগ্রহণঃ

নারীরা বিদেশী পণ্য বর্জন করে দেশীয় পণ্য ব্যবহারের জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন। ঘরে বসেই তাঁরা চুলা-চৌকিতে হোমশক্তির প্রদর্শন করে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। স্বদেশী দ্রব্যের ব্যবহার বাড়াতে স্বর্ণকুমারী দেবী ‘সখি সমিতি’ ও সরলাদেবী চৌধুরানী ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ স্থাপন করেন। নারীদের দ্বারা সম্পাদিত বিভিন্ন পত্রিকা যেমন-সরযুবালা সম্পাদিত ‘ভারত মহিলা’,সরলাদেবী চৌধুরানী সম্পাদিত ‘ভারতী’ বঙ্গভঙ্গ বিরোধী প্রচারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল।

বয়কট আন্দোলনে নারীদের ভূমিকাঃ

সঞ্জীবনী পত্রিকার সম্পাদক কৃষ্ণকুমার মিত্র ৭ ই আগস্ট বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে কলকাতা টাউন হলে বয়কট আন্দোলনের ডাকদেন। এই আন্দোলনে নারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। তারা বিদেশী শাড়ি, চুরি, লবণ, মসলা, ঔষধ এর ব্যবহার বন্ধ করে বিদেশি পণ্যাগারের সামনে পিকেটিংয়ে অংশগ্রহণ করে। এই প্রেক্ষাপটে কবি মুকুন্দ দাসের-‘ফেলে দাও রেশমি চুড়ি’ গানটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।

প্রচার ও জনমত গঠনঃ

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীরা জনমানষে জাতীয় চেতনা বৃদ্ধিতে সহায়কের কাজ করেছিল। তারা ‘মহিলা পরিষদ’, ‘ভারত মহিলা পরিষদ’, ‘মিলন মন্দির’, ‘সেবা সদন’ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান গঠন করে নারীজাতির মনে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটায়। ভগিনী নিবেদিতা, সরলা দেবী চৌধুরাণী, নির্মলা দেবী প্রমুখ এই প্রচারে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।

বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণঃ

কৃষ্ণকুমারী, নিরুপমা দেবী, দুকরিবালা দেবী, বিমলা দাসীসহ অনেক নারী বিপ্লবীদের সহায়তা করেন, লুকিয়ে রাখেন অস্ত্র ও প্রচারপত্র, এমনকি কিছু নারী গুপ্তচর হিসেবেও কাজ করেন।

বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে নারী সমাজ
সরলাদেবী চৌধুরানী

আন্দোলনে নেতৃত্ব:

বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে যে সমস্ত নারী নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন- সরলাদেবী চৌধুরানী, লীলাবতী মিত্র, নির্মলা সরকার, কুমুদিনী বসু, হেমাঙ্গিনী দাস, গিরিজা সুন্দরী, দুকরিবালা দেবী, সরোজিনী দেবী, লাবণ্যপ্রভা দত্ত, ব্রহ্মময়ী সেন প্রমুখ।

উপসংহারঃ

বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে নারীদের এই ব্যাপক অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে তাঁরা কেবল ঘরের কাজে সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং জাতীয় আন্দোলনেও তাঁদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। এই আন্দোলন নারী সমাজকে আরও আত্মবিশ্বাসী ও সাহসী করে তোলে এবং ভবিষ্যতে জাতীয় আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করে।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীদের সীমাবদ্ধতাঃ

বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হলেও এতে কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। সেই সময় সমাজে নারীদের অনেক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, যার ফলে তাঁদের আন্দোলনের পরিধি সীমিত ছিল।

সমাজের রক্ষণশীল মনোভাবঃ

ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ভারতীয় সমাজ ছিল রক্ষণশীল। নারীদের ঘরের বাইরে এসে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করাকে অনেকে ভালো চোখে দেখত না। ফলে অধিকাংশ নারী ছিলেন উচ্চবর্গের বাঙালি হিন্দু পরিবার ভুক্ত। কৃষক পরিবার বা মুসলিম পরিবারের তেমন কোন নারী প্রত্যক্ষভাবে এই আন্দোলনে যোগ দেয়নি।

পরিসরঃ

অধিকাংশ নারীর শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ ছিল না, যার ফলে তাঁরা রাজনৈতিক বিষয়ে সচেতন না থাকায় সমস্ত অঞ্চলের এবং সমস্ত শ্রেণীর নারীরা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি। ফলে আন্দোলন অংশগ্রহণকারী নারীদের অধিকাংশই ছিল শহুরে ও অভিজাত।

পুরুষ প্রাধান্যঃ

নারীরা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করলেও স্বাধীনভাবে তারা এই আন্দোলন পরিচালনা করতে পারেননি। পুরুষদের দ্বারাই আন্দোলনের যাবতীয় নীতি, কার্যপদ্ধতি সম্পাদিত হতো।

শেষ কথাঃ

এই সীমাবদ্ধতাগুলি সত্ত্বেও, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারীরা যে ভূমিকা রেখেছেন, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তাঁরা তাঁদের সীমিত সুযোগ এবং প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন এবং জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

কারিগরি শিক্ষার বিকাশে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট এর ভূমিকা: সম্পূর্ণ উত্তরটি দেখতে Click করুন এখানে।

তথ্যসূত্রঃ

এই ব্লগের কাজ করতে brainly.in সাহায্য নেয়া হয়েছে ।

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে নারী সমাজ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন-উত্তরঃ

প্রশ্ন: ‘রাখি বন্ধন’ উৎসব কেন অনুষ্ঠিত হয়?

উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে হিন্দু-মুসলিম ভাতৃত্বের বন্ধন হিসেবে ‘রাখি বন্ধন’ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

প্রশ্ন: ‘মিলন মন্দির’ কেন স্থাপিত হয়?

উত্তর: ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ১৬ ই অক্টোবর দুই বাংলার মিলনের প্রতীক হিসেবে আপার সার্কুলার রোডে ‘মিলন মন্দির’ এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়।

প্রশ্ন: ‘ভারত স্ত্রী মহামন্ডল’ কে প্রতিষ্ঠা করেন?

উত্তর: সরলা দেবী চৌধুরানী নারীদের একতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে ‘ভারত স্ত্রী মহামন্ডল’ প্রতিষ্ঠা করেন।

প্রশ্ন: মুসলিম পরিবারের কোন নারী স্বদেশী আন্দোলনের প্রচারে অংশ নেয়?

উত্তর: মুসলিম পরিবারের খাইরুন্নেসা ‘নব নুর’ নামক পত্রিকায় ‘স্বদেশানুরাগ’ নামক রচনা প্রকাশ করে স্বদেশী আন্দোলনের প্রচারে অংশ নেয়।

প্রশ্ন: ভারতীয় নারীরা প্রথম কোন আন্দোলনে অংশ নেয়?

উত্তর: ভারতীয় নারীরা বঙ্গভঙ্গ বিরোধী জাতীয় আন্দোলনে প্রথম অংশে নেয়। কারণ তারা বিদেশি দ্রব্য বর্জন করতে চেয়েছিল।

প্রশ্ন: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা কী ছিল?

উত্তর: নারীরা স্বদেশী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন, বিদেশি পণ্য বর্জন করেন, প্রচার ও জনমত গঠনে ভূমিকা রাখেন এবং বিপ্লবীদের সহায়তা করেন। তাঁরা বিভিন্ন সংগঠন গড়ে আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছিলেন।

প্রশ্ন: নারীরা কীভাবে অরন্ধন ও রাখিবন্ধন উৎসব পালন করেছিলেন?

উত্তর: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে নারীরা ১৬ অক্টোবর ১৯০৫ সালে অরন্ধন পালন করেন (অর্থাৎ সেদিন রান্না না করা)। এছাড়া, একতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ বৃদ্ধির জন্য রাখিবন্ধন উৎসব উদযাপন করেন।

প্রশ্ন: নারীরা কীভাবে বয়কট আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন?

উত্তর: নারীরা বিদেশি কাপড়, চুরি, লবণ, মসলা ও ওষুধ বর্জন করেন এবং দোকানগুলোর সামনে গিয়ে ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের আহ্বান জানান। তাঁরা প্রতিবাদী গান গেয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেন।

প্রশ্ন: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে নারীদের সীমাবদ্ধতা কী ছিল?

উত্তর: নারীদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ সমাজের রক্ষণশীল মনোভাব, পুরুষদের কর্তৃত্ব এবং শিক্ষার অভাবের কারণে সীমিত ছিল। অধিকাংশ অংশগ্রহণকারী ছিলেন শহুরে উচ্চবর্ণের নারী।

প্রশ্ন: বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ কেন গুরুত্বপূর্ণ ছিল?

উত্তর: এটি প্রথমবারের মতো নারীদের জাতীয় আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত করে, যা পরবর্তী স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের ভূমিকা নিশ্চিত করে এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটায়।

আরো পড়ুনঃ

Sharing Is Caring:

Leave a Comment